তিরিশের দশকের শেষের দিক। ক্রমাগত একটু একটু করে স্থিতাবস্থা হারাচ্ছে ইউরোপ। জার্মানি বিভক্ত হয়ে গেছে দুটি শিবিরে। একদিকে তথাকথিত ‘আর্য’-রা, অন্যদিকে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজন। বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ইহুদিদের ওপরে সেখানে অকথ্য অত্যাচার চলছে নাৎসি বাহিনীর। কাতারে কাতারে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। কেউ আবার সন্তান-সন্ততি-পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়ছেন। তবে নাৎসিদের আগ্রাসন থেমে থাকেনি এখানেই। বৃহত্তর আর্য বিশ্ব তৈরির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সর্বাধিনায়ক হিটলার। আর সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষেই ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ড (Poland) আক্রমণ করেন তিনি। চোখের সামনে বদলে গিয়েছিল গোটা দেশের ছবি। কয়েক মাসের মধ্যে পাঁচ লক্ষ ইহুদিকে ‘বন্দি’ করা হল ওয়ারশ ঘেটোতে। তালিকায় বাদ পড়ল না শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সন্তানসম্ভবারাও।
তবে পোলিশদের এই নরক-জীবনে সাক্ষাৎ দেবদূত হয়ে হাজির হয়েছিলেন বছর তিরিশের এক যুবতী। আইরিনা সেন্ডলার (Irena Sendler)। নাৎসি বাহিনী, গেস্টাপো এবং জার্মান গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে যিনি পরবর্তী ছ’বছর ধরে অবিরাম লড়াই করে গেছেন মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। ইহুদিদের জাল পরিচয়পত্র তৈরি করা থেকে শুরু করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের নাৎসিদের থাবামুক্ত করা— দুঃসাহসিক সব কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি শিশুর।
তবে আইরিনার এই কিংবদন্তির ভ্রূণ লুকিয়ে রয়েছে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। ১৯১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। আইরেনার জন্ম পোল্যান্ডের ওটওয়াক শহরে। বাবা স্তানিস্ল ছিলেন চিকিৎসক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পোল্যান্ডজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে টাইফাস মহামারী। সে-সময় প্রাণের মায়া ত্যাগ করেই সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। এমনকি জনসেবার জন্য শেষ অবধি দিতে হয়েছিল নিজের প্রাণও। টাইফাসেই মৃত্যু হয়েছিল স্তানিস্ল-এর। আইরিনার ধমনীতেও যেন প্রবাহিত হয়েছিল বাবার রক্ত। সাম্য এবং জনসেবা— এই দুটি শব্দকেই নিজের জীবনের মন্ত্র করে নেন আইরিনা।
বিশের দশকের শেষের দিকে বাসাবদল করেন আইরিনা। প্রান্তিক ওটওয়াক ছেড়ে চলে আসেন ওয়ারশ-তে। আর সে-সময়ই ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তাঁর নজরে পড়ে আশ্চর্য এক দৃশ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে তখনও বছর দশেক বাকি। অথচ, তখন থেকেই মেরুকরণ শুরু হয়ে গেছে জার্মানি এবং পোল্যান্ডের সমাজে। পাশাপাশি বসে ক্লাস করে না ইহুদি এবং ‘আর্য’-রা। ক্যান্টিনেও ইহুদিদের জন্য ভিন্নতর ব্যবস্থা। জাতিতে ‘আর্য’ হওয়া সত্ত্বেও এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হন সাম্যবাদে বিশ্বাসী আইরিনা। তার জন্য তাঁকে সাসপেন্ডও হতে হয় কলেজে। তবে থেমে থাকেননি তিনি। বরং, সমাজকর্মী হিসাবে নাম লেখান পোল্যান্ড সরকারের ‘সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট’-এ। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচার করাকে হাতিয়ার করেন নেন তিনি।
১৯৩৯ সালে যখন হিটলারের বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তখনও এই কর্মরত এই বিভাগেই। তবে নাৎসি আক্রমণের পরই বদলে যায় তাঁর কাজের ধরন। সচেতনতা প্রচার করা থেকে সরে এসে জাল নথি তৈরি করতে শুরু করেন আইরিনা এবং তাঁর সহকর্মীরা। কখনও ছাপাতেন জাল ভিসা, কখনও আবার ভুয়ো পরিচয়পত্র। ১৯৩৯-৪২— এই তিন বছরের মধ্যেই অন্ততপক্ষে ৩ হাজার পরিবারের প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাঁর তৈরি জাল নথি।
ততদিনে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। আরও নৃশংস হয়ে উঠেছে নাৎসিরা। তাঁদের খিদে থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ইহুদি শিশু, কিশোর-কিশোরীরা। অন্যদিকে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন জার্মানির অধীনে। ফলে পোল্যান্ড থেকে পালিয়ে সপরিবারে যাওয়ারও পথও প্রায় বন্ধ। তবে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন তিনি? না, এরপর শিশুদের বাঁচাতে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন তিনি।
আসলে সে-সময় পোল্যান্ডে বসবাসকারী বহু ‘আর্য’ পরিবারও সামিল হয়েছেন এই যুদ্ধে। কোনো স্বার্থ ছাড়াই, তাঁরা ইহুদি শিশু ও কিশোরদের প্রাণ বাঁচাতে, লালন-পালন করতে রাজি। ঘেটো এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ইহুদি শিশুদের নিয়ে এসে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন ‘জেগোটো’ নামের এক গুপ্তসংস্থার কর্মীরা। ১৯৪২-এর শেষের দিকে এই সংস্থাতেই যোগ দেন আইরিনা।
বাবা চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে চিকিৎসার সামান্য জ্ঞান ছিলই, পাশাপাশি সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করার সময় শিখেছিলেন নার্সিং-এর অ-আ-ক-খ-ও। ফলে চিকিৎসাকর্মীর ছদ্মবেশ নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি আইরিনার। সেইসঙ্গে নিজের জাল পরিচয়পত্রও প্রস্তুত করে ফেলেন তিনি। শুরু হয় উদ্ধারকার্য। চিকিৎসাকর্মী হওয়ায় অবাধেই ঘেটোয় প্রবেশাধিকার পেতেন তিনি। কখনও পিঠের ব্যাগে, কখনও স্যুটকেসে আবার কখনও খাবারের বস্তায় লুকিয়ে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের পাচার করে দিতেন ‘জেগোটো’-র কাছে। আর তাদের বাবা-মাকে প্রতিশ্রুতি দিতেন, যুদ্ধের পরই ফিরিয়ে দেওয়া হবে তাঁদের সন্তানদের। সকলেই যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তাঁদের শিশুকে তুলে দিতেন আইরিনার হাতে, এমনটা নয়। কেউ কেউ স্রেফ চোখের সামনে নিজের সন্তানের মৃত্যু দেখবেন না বলেই হয়তো তুলে দিতেন আইরিনার হাতে।
অবশ্য নিজের প্রতিশ্রুতি একশো শতাংশ রক্ষা পালন করতে পেরেছিলেন আইরিনা এমনটা নয়। সবমিলিয়ে তিন বছরে আড়াই হাজার শিশুকে ঘেটো থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি এবং তাঁর ১০ সহকর্মী। যার মধ্যে ৪০০-র বেশি উদ্ধারকার্যের নেপথ্যে ছিলেন স্বয়ং আইরিনা। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঘেটো কিংবা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই প্রয়াত হন শিশুর বাবা-মা। অধরা থেকে যায় পুনর্মিলন প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র কাজ বদলে যায় আইরিনার। বিশ্বযুদ্ধের পর অনাথ শিশুদের দেখাশোনা এবং শিক্ষাদানের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আইরিনা। জড়িত ছিলেন পোল্যান্ডের একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে।
অবশ্য তাঁর এই কাহিনি প্রকাশ্যে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু পরে। ততদিনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে পোল্যান্ড। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠছে তাঁর সাহায্য পাওয়া দুধের শিশুরাও। তেমনই এক ইহুদি যুবকের সূত্রেই প্রথম প্রকাশ্যে আসে আইরিনার কথা। তাঁর প্রাণও বাঁচিয়েছিলেন পোলিশ এই মহীয়সীই। তারপর ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসে প্রাচীন নথিপত্র। কিংবদন্তি হয়ে ওঠে সেন্ডলারের কাহিনি। আধুনিক বিশ্বের কাছে যা মানবিকতা, সাহসিকতার এবং সাম্যের প্রতীক!
Powered by Froala Editor