১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। পোল্যান্ড আক্রমণ করে নাৎসি জার্মানি। আর সেই সঙ্গেই বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কা। অবশ্য তখনও পর্যন্ত পোল্যান্ডের আস্থা ছিল এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে তারা। তবে জার্মান আক্রমণের কিছুদিন পর হামলা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্লোভাক রিপাবলিক। ত্রিমুখী এই আক্রমণের সামনে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে পোল্যান্ডের রক্ষণ। অক্টোবর মাসে এই যুদ্ধে ইতি পড়ার পরই নাৎসি বাহিনি পোল্যান্ডের বুকে গড়ে তোলে প্রকাণ্ড এক কারাগার। অবশ্য তারা এটিকে কারাগার বলত না। চিহ্নিত করত ‘আউশউইটজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ নামে।
১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে খুলে যায় এই আশ্চর্য কারাগারের দরজা। প্রাথমিকভাবে পোল্যান্ডের (Poland) রাজনৈতিক বন্দিদেরই সেখানে রাখত নাৎসিরা। আশ্চর্যের বিষয় হল, হাজার হাজার মানুষকে বন্দি হিসাবে এই কারাগারে পাঠানো হলেও, ছাড়া পেতেন না কেউ। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় পোলিশদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, কীভাবে রাজনৈতিক বন্দিদের রাখা হচ্ছে সেখানে? তাঁদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে জার্মান সেনারা? আদৌ কি জীবিত রয়েছেন তাঁরা? না, এসব তথ্য বিন্দুমাত্রও প্রকাশ্যে আসত না বাইরে।
সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন, ‘পোলিশ রেজিস্ট্যান্স’ দলের এক সদস্য উইটোল্ড পিলেস্কি (Witold Pilecki)। অবশ্য তাঁকে শুধু আন্দোলনকারী বা বিপ্লবী বললে, সঠিক বিচার হয় না। কারণ, ১৯২০-র পোলিশ-সোভিয়েত যুদ্ধের সেনা ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ১৯৩৯-এ জার্মান আক্রমণের সময়ও গোয়েন্দার ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ঠিক হয়, কয়েদির ছদ্মবেশে তিনি প্রবেশ করবেন আউশউইটজ ক্যাম্পে। তারপর সেখান থেকেই তিনি গোপন তথ্য পাচার করবেন পোলিশ আন্দোলনকারীদের। পাশাপাশি কারাগারের মধ্যেও গড়ে তুলবেন প্রতিরোধ।
পরিকল্পনামাফিক ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি রাজনৈতিক র্যালিতে অংশ নেন তিনি। নাৎসি জার্মানির বিরোধিতা করার জন্য সে-সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে জার্মান পুলিশ। শুধু পিলেস্কিই নয়, গ্রেপ্তার হন আরও ৪০০ আন্দোলনকারী। ‘ছাড়পত্র’ মিলে যায় অভিশপ্ত আইশউইটজে প্রবেশের।
না, শুরুটা মোটেই ভালো হয়নি পিলেস্কির। হিটলারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার অপরাধে প্রথমদিনই মুগুর দিয়ে পেটানো হয়েছিল তাঁকে। অবশ্য তাতে হার মানেননি তিনি। কারাগারের বন্দিদের নিয়ে গড়ে তুলতে শুরু করেন বিশেষ সংগঠন। চালু করেন ‘সিস্টেম অফ ফাইভ’ নামের একটি বিশেষ ব্যবস্থা। কিন্তু কী এই ‘সিস্টেম অফ ফাইভ’?
মূলত, বন্দিদের দিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ করানো হত আউশউইটজে। আর সেই কাজে সামান্যতম ভুল হলেও মিলত কঠোর শাস্তি, নির্যাতন। এর প্রতিকার হিসাবেই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের পাঁচজন করে বন্দি নিয়ে ছোটো ছোটো দল গড়ে তোলেন পিলেস্কি। যা পরিচিত ছিল ‘সিস্টেম অফ ফাইভ’ নামে। ‘সিস্টেম অফ ফাইভ’-এর দৌলতে শাস্তির পরিমাণ কমেছিল কিনা, সে-ব্যাপারে কোনো প্রামাণ্য তথ্য মেলেনি আজও। তবে এ-কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই ব্যবস্থা ঐক্য বৃদ্ধি করেছিল বন্দিদের মধ্যে।
এই দল গঠনের পর শুরু হয়, তথ্য পাচারের প্রক্রিয়া। আউশউইটজের খুব অল্প সংখ্যক বন্দিই সুযোগ পেতেন কারাগারের বাইরে কাজ করার। মূলত বেকারি কিংবা টেক্টাইল কর্মী হিসাবেই তাঁদের অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হত জেলের বাইরে। তাঁদের মাধ্যমেই আউশউইটজ ক্যাম্পের পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ নকশা এবং জীবনযাপনের পদ্ধতির মতো গোপন তথ্য পাচার করতেন পিলেস্কি। খাদ্য, বস্ত্র, অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রীও পৌঁছে দিতেন আন্দোলনকারীদের মধ্যে।
আউশউইটজে আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন পিলেস্কি। আশ্চর্যের বিষয় হল, শুধু পোলিশ আন্দোলনকারীই নয়, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছেও এইসব গোপন তথ্য পৌঁছে দিতেন তিনি। এমনকি তাঁর প্রদত্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আউশউইটজ আক্রমণের ব্যাপারেও পরিকল্পনা করেছিল ব্রিটেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন উইনস্টন চার্চিল। ১৯৪৩-এ এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গণহত্যা শুরু হলে, কোনো মতে সেখান থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি। বাইরে এসে যোগ দেন মূল আন্দোলনে। তবে রক্ষা হয়নি সেখানেও। ১৯৪৪ সালে ফের গেস্টাপোর হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। বন্দি করে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় ‘দ্বিতীয় আউশউইটজ’-খ্যাত বিরকেনিউ ক্যাম্পে। বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত সেখানেই বন্দি ছিলেন তিনি।
১৯৪৫ সালে জার্মানির আত্মসমর্পণের পর মুক্তি পান তিনি। তবে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার পরও সুবিচার পাননি তিনি। বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট সরকার গঠনের পর ফের প্রশাসনের অরাজনৈতিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন পিলেস্কি। ১৯৪৭ সালে সেই অপরাধেই ফের বন্দি হতে হয় তাঁকে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অকথ্য অত্যাচার চলে তাঁর ওপর। ১৯৪৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত একটি ট্রায়ালে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘোষণা করা হয় তাঁকে। ঘোষিত হয় মৃত্যুদণ্ড। এর মাস দুয়েক পর ২৫ মে ওয়ারশ’ মকোটা কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয় পিলেস্কিকে। অবশ্য তাঁর মৃত্যুসংবাদও প্রকাশ্যে আসেনি সে-সময়। এমনকি কারাগারে একাধিকবার পিলেস্কির সঙ্গে তাঁর বোন দেখা করতে গেলেও ফিরে দেওয়া হয় তাঁকে।
১৯৮০ সালে কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর প্রথমবারের জন্য প্রকাশ্যে আসে তাঁর সংগ্রামের কাহিনি। পরবর্তীতে জাতীয় নায়ক হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাঁকে। আউশউইটজ এবং ওয়ারশ-এ গড়ে তোলা হয় তাঁর মূর্তিও। জীবিত অবস্থায় বিচার না পেলেও, ইতিহাসের পাতায় বর্তমানে জায়গা পেয়েছেন সাবেক পোলিশ সৈনিক তথা গোয়েন্দা…
Powered by Froala Editor