প্রেমে শুধুই কি মন তরুণ থাকে? নাকি সারা জীবনকেই তারুণ্যে ভরিয়ে রাখে প্রেম? সময়ের স্রোতে অনেক কাহিনিই হারিয়ে যায়। অনেক পাওয়া না পাওয়ার হিসাব হারিয়ে যায়। দাগ দিলভি আর মুন্নিবাইয়ের কাহিনি কিন্তু হারিয়ে যায়নি। শায়রির পাতায় পাতায় লেখা আছে সেই অপরিণত আখ্যানের খুঁটিনাটি।
রামপুরের বার্ষিক মেলা ‘বেনজির’ হয়তো নামে সার্থক হয়ে উঠেছিল এই অমর প্রেমগাথার জন্যই। সেখানেই প্রথম দেখা দুজনের। কলকাতা থেকে রামপুরের মেলায় ঘুরতে গিয়েছেন মুন্নিবাই। আর দাগ তখন দরবারের কবি। মুন্নিবাইয়ের রূপে মুগ্ধ হলেন দাগ। আর মুন্নিবাই মুগ্ধ হলেন তাঁর কবিতায়। দুজন দুজনকে অজান্তেই ভালোবেসে ফেললেন। কিন্তু এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেল রামপুরের মেলা। এবার বিদায় নেওয়ার পালা।
“ইশক নেমাত হ্যায় আদমি কে লিয়ে
ইশক জান্নাত হ্যায় আদমি কে লিয়ে।
দিল ইসি সে জওয়ান রহেতা হ্যায়
মার্মিতোঁ কা নিশান রহেতা হ্যায়।”
মুন্নিবাইকে বিদায় দিলেন দাগ। শুধু কথা হল, প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুটি অরে চিঠি লিখবেন দাগকে। এভাবেই চলল বেশ কিছুদিন। দাগ লিখেছিলেন, “রসম-এ-উলফত কে হো গায়ে ইকরার/ খাত কিতাবত কে হো গায়ে ইকরার।” আর উত্তরে মুন্নিবাই লিখেছিলেন, “জি নেহি চাহতা হ্যায় জানে কো/ পর চলতা হ্যায় কলক উঠানে কো।” সেই ‘কলক’ শুধু মুন্নিবাইকেই ছুঁয়ে যায়নি, ছুঁয়ে গিয়ছিল দাগ দিলভিকেও। কিছুদিন যেতেই দেখা গেল চিঠিপত্র আর নিয়মিত আসছে না। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেন দাগ। চিঠি লিখে মুন্নিকে জানালেন, ঠিক সময় উত্তর না পেলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন তিনি। না, তাতেও কোনো উত্তর পেলেন না। অবশ্য মৃত্যু হল না দাগের। হয়তো শায়রিই বাঁচিয়ে রেখেছিল তাঁকে। নিজের অতৃপ্ত প্রেমকে শব্দে শব্দে মূর্ত করে তুলেছিলেন তিনি।
রামপুর তখন নবাবি শাসনের শেষ সময়কে ধরে রেখেছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন সেখানে। কলকাতা থেকেও আসেন অনেকে। বাঙালিদের দেখলেই চঞ্চল হয়ে ওঠেন দাগ। জিজ্ঞেস করেন মুন্নিবাইয়ের কথা। কিন্তু না, কেউই তার সন্ধান দিতে পারেন না। মাঝে মাঝে অনিয়মিত কিছু চিঠির উত্তর আসে। দাগ বুঝতে পারেন, সে বেঁচে আছে। এর মধ্যেই আরও এক ‘বেনজির’ মেলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৮৮১ সাল। দাগ মনে মনে ভাবতে লাগলেন, আসবে কি? এবারেও আসবে কি? হ্যাঁ আবারও দেখা হল দুজনের, সেই মেলার উপলক্ষে।
এবারের আলাপ কিন্তু খুব মধুর ছিল না। ততদিনে দাগের সম্পর্কে নানা মিথ্যে কথা বলে মুন্নিবাইয়ের মন বিষিয়ে তুলেছেন পরিচিত মানুষরা। মুন্নিবাইয়ের ভালোবাসাও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দাগকে দেখার পর সেই অভিমান আর বেশিদিন টিকল না। আবারও নতুন করে শায়রকে ভালোবেসে ফেললেন তিনি। ফেরার সময় দাগকে কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এলেন মুন্নিবাই। দাগও অচিরেই বেরিয়ে পড়লেন। দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, আজিমাবাদ হয়ে এলেন কলকাতায়। ১৮৮৩ সালে বর্তমান নাখোদা মসজিদের কাছে একটি বাড়িতে আস্তানা গাড়লেন তিনি।
কলকাতায় ৩ মাস ছিলেন দাগ দিলভি। এই ৩ মাসে ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্কও পরিণতি পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ নবাব কালবে আলি খানের মৃত্যুর সংবাদ এল। দাগকে আবার ফিরে আসতে হল রামপুরে। সেখানেও আর স্থান হল না। ভাগ্যান্বেষণের সূত্রে চলে গেলেন দিল্লি। এই শহরেই বড়ো হয়েছেন তিনি। তবে দিল্লি শহরেও বেশিদিন থাকলেন না। দাগের শায়রির প্রশংসা শুনে তাঁকে ডেকে পাঠালেন হায়দ্রাবাদের নিজাম। উত্তর ভারত ছেড়ে দাগ পাড়ি দিলেন সুদূর দক্ষিণে। এর মধ্যে মুন্নিবাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন কিনা, জানা যায় না। করলেও তো সন্ধান পেতেন না।
দাগ দিলভির জীবন চলল নতুন ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু মন পড়ে থাকল কলকাতায়। তাই ১৮৯৯ সালে যখন নিজাম কলকাতার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন, তখন তাঁর সঙ্গী হলেন দাগ। আবারও দেখা হবে মুন্নিবাইয়ের সঙ্গে? দেখা হল ঠিকই। কিন্তু এমন একটা পরিচয়ের জন্য দাগ প্রস্তুত ছিলেন না। মুন্নিবাই ততদিনে এক মৌলভিকে বিয়ে করেছেন। দুজনের সংসারে দাগের কোনো জায়গা নেই। জায়গা নেই শায়রির। এই মুন্নিবাইকে তো দাগ চেনেন না। তিনি অবশ্য কাজির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, তিনি যেন নতুন করে মুন্নিবাইকে নিকাহ করার সুযোগ পান। না, কাজি সেই সুযোগ দিলেন না। বরং তাঁদের সম্পর্ককে নিয়ে যেন খানিক রসিকতাই শুরু হয়ে গেল কলকাতা শহরে। শুধু শায়রির জন্য প্রেম? এমনটা আবার হয় নাকি?
জীবন এগিয়ে চলল। একটু একটু করে বার্ধক্যের মুখে ঝুঁকে পড়লেন দাগ দিলভি। এর মধ্যেই হঠাৎ মুন্নিবাইয়ের বার্তা পেলেন দাগ। মুন্নিবাই হায়াদ্রাবাদ আসছেন। কিন্তু শর্ত একটাই, দাগ তাঁকে নিকাহ করবেন, তাঁর থাকার ব্যবস্থা করবেন। আর তাহলেই তিনি দাগের সঙ্গে দেখা করবেন। দাগও প্রস্তাব মেনে নিলেন। হায়াদ্রাবাদ শহরে মুন্নিবাইয়ের জন্য আলাদা একটি বাড়ির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধের নিকাহ মেনে নেয়নি সমাজ-পরিজন। ফলে দুজনের মুখোমুখি দেখা হল না আর। এই শেষ আঘাত সহ্য করতে পারলেন না দাগ দিলভি। ১৯০৪ সালে শয্যা নিলেন তিনি। আর সুস্থ হয়ে উঠলেন না। ১৯০৫ সালে তাঁর জীবনের সমাপ্তি হল। সমাপ্তি হল এই অপরিণত প্রেম-কাহিনির। শুধু থেকে গেল তাঁর অসংখ্য শায়রি। আর তার মধ্যে প্রেমের চিরন্তন অনুভূতি। শেষ জীবনের সেই অতৃপ্তি লিখে গেলেন দাগ,
“হায়ে জিতে হ্যায় হাম না মরতে হ্যায়
কিস কায়ামত কে দিন গুজরতি হ্যায়
খানা-ই-আয়েস লুট গ্যায়ে ক্যায়সা
মুঝ সে মাসুক ছুট গ্যায়ে ক্যায়সা।”
তথ্যসূত্রঃ The love-life of Nawab Mirza Khan Dagh Dehlvi (1831-1905), Anisur Rahman, Rekhta Blog
Powered by Froala Editor