ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতলেও, ১৯৬৬-র নায়ক এক পর্তুগিজ তারকা

১৯৬৬ সাল ইংল্যান্ডের ফুটবল-অনুরাগীদের কাছে একটা মাইলস্টোনই বটে। সেবার বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব যেমন পেয়েছিল তারা, তেমনই তাদের ঘরে উঠেছিল জুলে রিমে ট্রফি। ফুটবল ইতিহাসের জগতেও কম নাটকীয় ছিল না এই বিশ্বকাপ। প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই ট্রফি চুরি যাওয়া, তারপর এক পোষ্য সারমেয়ের সৌজন্য আবার ট্রফি-উদ্ধার। সবমিলিয়ে জমজমাট ছিল সেবারের ‘বিশ্বযুদ্ধ’। তবে থ্রি-লায়ন্স বিশ্বজয় করলেও, ১৯৬৬-র বিশ্বকাপের নায়ক ছিলেন এক পর্তুগিজ (Portuguese)।

ইউসেবিও ডা সিলভা ফেরেইরা (Eusebio Da Silva)। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনি পরিচিত ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ নামে। ১৯৬৬-র বিশ্বকাপে পর্তুগালকে একা হাতেই সেমিফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন ইউসেবিও। তবে পর্তুগালের হয়ে খেললেও ইউসেবিও-র জন্ম আদতে মোজাম্বিকে। ১৯৪২ সালে। সে-সময় মোজাম্বিক ছিল পর্তুগালের উপনিবেশ। ছোটো থেকেই ফুটবল পেটাতে ভালোবাসতেন, ধীরে ধীরে সেটাই পেশা হয়ে ওঠে তাঁর। 

ইউসেবিও-র বয়স মাত্র আট বছর তখন। টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন ইউসেবিও-র বাবার। চার ভাই-বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনিই। কাজেই তখনও পর্যন্ত পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার চাপ আসেনি তাঁর ওপর। তবে আরেকটু বড়ো হতে, নিজেই সংসারের হাল ধরার চেষ্টায় মাঠে নেমে পড়েন তিনি। প্রথমে পাড়া ফুটবল, তারপর স্থানীয় ক্লাব ‘ওস ব্রাসিলোস’-এ শুরু করেন খেলা। তাতে সামান্য আয় হত বৈকি। সে-সময়ই পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকার এক কর্মকর্তা লরেঞ্জো মার্কেজের নজরে পড়ে যান ইউসেবিও। চলে আসেন লিসবনে। শুরু হয় এক নতুন জীবন। 

বেনফিকায় নজিরবিহীন ফর্ম মেলে ধরেই, ১৯৬৬ সালে পর্তুগালের জাতীয় দলে সুযোগ জুটিয়ে নেন তিনি। মজার বিষয় হল, সেটাই ছিল পর্তুগালের প্রথম বিশ্বকাপ। আর প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে নেমেই সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল পর্তুগাল। জিতেছিল তৃতীয় স্থানের ম্যাচও। প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজক উরুগুয়ের কথা বাদ দিলে, এমন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত আর কোনো দেশেরই নেই। আর এই আশ্চর্য দলগত কীর্তির নেপথ্যে ছিলেন ২৪ বছর বয়সি ইউসেবিও। 

১৯৬৬-র বিশ্বকাপে নজরকাড়া দল নিয়ে ইংল্যান্ড মাঠে নেমেছিল ঠিকই, তবে সেবারের হট টপিক ছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলই। পেলে, গ্যারিঞ্চা, রিল্ডোদের স্বর্ণযুগ তখন। পরপর দুটি বিশ্বকাপ পকেটে পুরেছেন তাঁরা। অপেক্ষা তৃতীয়ের। তবে সেই ব্রাজিলই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায় গ্রুপ পর্বেই। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার হয়ে জয় হাসিল করলেও, দ্বিতীয় ম্যাচে ৩-১ গোলে হাঙ্গেরির কাছে হারে সেলেকাওরা। তৃতীয় ম্যাচের ব্রাজিল মুখোমুখি হয় পর্তুগালের। ব্রাজিল সমর্থকরা তো বটেই, বিশ্বের তাবড় ফুটবল বিশেষজ্ঞরাও অনুমান করেছিলেন জিতবে ব্রাজিলই। তবে ইউসেবিও-র দৌলতে ম্যাচের ফলাফল হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। সেদিন দু-দুবার ব্রাজিলের জালে বল জড়িয়েছিলেন তিনি। আর ব্রাজিলের বিরুদ্ধে করা তাঁর দ্বিতীয় গোলটিই সেরা গোলের তকমা পায় সেই বিশ্বকাপে। ন্যারো-অ্যাঙ্গেল থেকে ইউসেবিও-র নিখুঁত ভলি নির্বাক করে দিয়েছিল গোটা দুনিয়াকে। 

এখানেই শেষ নয়, ব্রাজিলের সঙ্গে গ্রুপ পর্বে হেভিওয়েট হাঙ্গেরিকেও ৩-১ গোলে হারিয়েছিল পর্তুগাল। সেবার নিজে গোল না করলেও, ডিফেন্স চেরা পাসে গোল করান সতীর্থ টোরেসকে দিয়ে। তবে ইউসেবিও-র সবচেয়ে চমকপ্রদ পারফর্মেন্স দেখা যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। সেবার তারা মুখোমুখি হয়েছিল উত্তর কোরিয়ার। পর্তুগালের মতোই ১৯৬৬-র বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে গিয়েছিল পূর্ব-এশিয়ার এই দেশটিও। তবে ধারা-ভারে তাদের থেকে পর্তুগালকেই খানিক এগিয়ে রেখেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। 

১৯৬৬ সাল। ২৩ জুলাই। লিভারপুলের মাঠে সেদিন শুরুতেই অঘটন ঘটিয়ে দেয় উত্তর কোরিয়া। মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যেই তিন-তিনটি গোল হজম করতে হয়েছিল পর্তুগালকে। এরপর প্রায় একা হাতেই দলকে সেমি-ফাইনালে টেনে নিয়ে যান ইউসেবিও। হাফ টাইমের আগেই দুটি গোল করেছিলেন তিনি। বিরতির পর আরও দুটি গোল। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে তাঁর পাস থেকে উত্তর কোরিয়ার কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেন হোসে অগাস্টো। ম্যাচ শেষ হয়েছিল ৫-৩ ফলাফলে।

ইউসেবিওর এই বিজয়যাত্রা হোঁচট খায় সেমি ফাইনালে গিয়ে। ববি চার্লটনের জোড়া গোলে পর্তুগালকে বশ করে ইংল্যান্ড। তবে সেদিনও একটি গোল করেছিলেন ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। তৃতীয় স্থানের ম্যাচে সোভিয়েতের বিরুদ্ধেও গোল করেছিলেন তিনি। টুর্নামেন্টের সেরা গোল তো বটেই, সর্বোচ্চ গোল করেও রীতিমতো নজর কেড়েছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে সেই বিশ্বকাপে তাঁর গোল ট্যালি ছিল ৯। অন্যদিকে দ্বিতীয়স্থানে থাকা জার্মান স্ট্রাইকার হেলমুট হলারের গোলসংখ্যা ছিল ৬।

আশ্চর্যের বিষয় হল, ১৯৬৬-ই শেষ বিশ্বকাপ হয়ে থেকে যায় ইউসেবিও-র জীবনে। তারপর আর কোনোদিন বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ আসেনি তাঁর। তার কারণ আর কিছুই নয়, ১৯৮৬-র আগে আর বিশ্বকাপের যোগ্যতা আদায় করতে পারেনি পর্তুগাল। এমনকি ১৯৬৬-র পর থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ফাইনালে খেলা বা তৃতীয় স্থান অধিকারের সৌভাগ্যও হয়নি পর্তুগিজদের। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রোনাল্ডো কিংবা ফিগোর থেকেও কি খানিক এগিয়ে রাখা যায় না ’৬৬-র বিশ্বকাপের নায়ক ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-কে?

Powered by Froala Editor