কালো কাপড়ের তৈরি পতাকা। তার গায়ে সাদা রং দিয়ে আঁকা মানব কঙ্কালের মাথা আর তার নিচে ইংরাজি ‘X’ হরফের আকারে সাজানো দুটি হাড়। একসময় সমুদ্রের বুকে কোনো জাহাজের গায়ে এই পতাকা উড়তে দেখলেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত যে-কোনো মানুষের। যাঁরা ‘পাইরেটস অফ দি ক্যারিবিয়া’ সিরিজটি দেখেছেন, তাঁদের নতুন করে এই চিহ্নের সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। হ্যাঁ, এই পতাকা জলদস্যুদের প্রতীক। বিশ শতকেরও শুরুর দিকেও গোটা বিশ্বজুড়ে জলদস্যুদের প্রভাব থাকলেও, বর্তমানে সোমালিয়া, মোজাম্বিক-সহ কয়েকটি মাত্র দেশেই সীমাবদ্ধ প্রথাগত পাইরেটদের কার্যকলাপ। তবে বিশ্বের দক্ষিণতম মহাদেশ আন্টার্কটিকায় (Antarctica) গেলে দেখা মিলবে এক ভিন্নধরনের জলদস্যুর (Pirates)।
হ্যাঁ, যে-মহাদেশে স্থায়ী বাস নেই মানুষের, যেখানে পাড়ি দিতে গেলে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে যুদ্ধ চালাতে হয় ভয়াবহ ঠান্ডা এবং উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে, সেই আন্টার্কটিকাতেও জলদস্যু! অবশ্য সাধারণ মানুষের জাহাজে লুঠতরাজ চালায় না এইসব জলদস্যুরা। বরং, মানুষের পরিবর্তে তাদের শিকার হয় প্রকৃতি। আসলে আন্টার্কটিকা সংলগ্ন দক্ষিণ মহাসাগরে বসবাস বহু বিরল গোত্রের মাছ, কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন ও অন্যান্য প্রাণীর। অনিয়ন্ত্রিত এবং বেআইনিভাবে এইসব প্রাণীদের শিকার করে একদল মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এবং পরিবেশবিদদের কাছে তারাই পরিচিত ‘আন্টার্কটিকার জলদস্যু’ হিসাবে। অবশ্য পাইরেট নয়, এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘ইকো-পাইরেট’ শব্দবন্ধটি।
১৯৭০-র দশকের গোড়া থেকেই দক্ষিণ মহাসাগর হয়ে উঠেছিল মৎস্য শিকারের অন্যতম কেন্দ্র। লাতিন আমেরিকান দেশগুলি তো বটেই, পাশাপাশি দক্ষিণ মহাসাগরে অবৈধভাবে মৎস্য শিকার করত আফ্রিকা, জাপান, চিন, রাশিয়া-সহ বিশ্বের সহস্রাধিক মৎস্যজীবী। ক্রিল এবং টুথ ফিশ— প্রধানত এই দুই প্রজাতির মাছই শিকার করত তারা। তাছাড়াও শিকার করা হত তিমি এবং ডলফিনও। যদিও এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মূলত যুক্ত থাকতেন নরওয়ে এবং জাপানের মানুষরা।
সে-সময় একাধিক গবেষণায় উঠে আসে, তথাকথিত এই ‘সভ্য’ জলদস্যুদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত হচ্ছে দক্ষিণ মহাসাগরের বাস্তুতন্ত্র। নির্বিচারে শিকারের ফলে ক্রমশ সংখ্যা কমছে বিরল প্রজাতির মাছ, তিমি, ডলফিন এবং পেঙ্গুইনদের। পাশাপাশি অবৈধ মৎস্যশিকারের ফলে সমুদ্রে বাড়ছে ঘোস্ট ওয়্যার বা পরিত্যক্ত মৎস্য শিকারের জাল ও বর্জ্যের পরিমাণ। যা ব্যাহত করছে শীল, ডলফিন এবং পেঙ্গুইনদের পরিযায়নকে। তবে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং দক্ষিণ মহাসাগরের প্রকাণ্ড আকারের জন্যই সে-সময় কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি।
১৯৭৭ সালে আন্টার্কটিকার ইকো-পাইরেটদের সায়েস্তা করতে শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র একটি সংগঠন গড়ে তোলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিবেশবিদরা। ‘সে শেফার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’-খ্যাত এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কানাডিয়ান পরিবেশবিদ পল ওয়াটসন। ১৯৭৮ সালে ‘ফান্ড ফর অ্যানিম্যাল’ এবং ‘রয়্যাল সোসাইটি’-র অর্থ সাহায্য নিয়ে আস্ত একটি জাহাজ কিনে ফেলেন তিনি। এই জাহাজে চাপেই দক্ষিণ মহাসাগরে টহল দিয়ে বেড়াতেন তিনি এবং তাঁর সতীর্থ পরিবেশবিদরা।
পলের বিশ্বাস ছিল, শুধুমাত্র জনসচেতনতা প্রচারের মাধ্যমে এই জলদস্যুদের প্রভাব ঠেকানো অসম্ভব। তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে কখনও কখনও বেছে নিতে হবে হিংসার পথও। হ্যাঁ, একাধিকবার সেই পথেই হেঁটেছিলেন তিনি। কখনও নরওয়ের তিমি শিকারের জাহাজের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া, কখনও আবার জাপানের পাঠানো রণতরীকে জাহাজ দিয়ে আঘাত করা— একাধিকবার আইন লঙ্ঘন করে সংঘর্ষে জড়িয়েছে পলের এই সংগঠন। স্মোক গ্রেনেড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ারও ব্যবহার করতেন পল ও তাঁর সতীর্থরা। তা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। বহুবার জেলও খাটতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি ২০১০ সালে জাপানের রণতরীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার দায়ে ইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড লিস্ট’-এও নাম উঠেছিল তাঁর। সে এক অন্য কাহিনি। সেই গল্পকে অবলম্বন করে পরবর্তীতে তৈরি হয় আস্ত একটি তথ্যচিত্রও।
তবে এত কিছুর পরেও আজ দিব্যি দক্ষিণ মহাসাগরে সক্রিয় অবৈধ মৎস্যশিকারের চক্র। চোরা-গোপ্তা শিকার করা হয় তিমি ও ডলফিনও। এমনকি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, অবৈধ মাছ শিকারের কারণে প্রায় অবলুপ্ত হতে বসেছে দক্ষিণ মহাসাগরের নেটিভ প্রজাতি ‘প্যাটাগোনিয়ান টুথফিশ’। একাধিক আইন প্রণয়ন করেও মেলেনি সমাধান। আসলে এই জলদস্যুদের সঙ্গে লড়ার আগে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে লড়তে হয় উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে। প্রকৃতির সেই করাল রূপকে বশীভূত করবে, সাধ্য কার? একমাত্র এই সমস্যার ইতি টানতে পারে অবৈধ মৎস্য শিকারের সঙ্গে জড়িত দেশের সরকারগুলিই। কিন্তু সেই সুবুদ্ধির উদ্ভব হবে কবে, তা জানা নেই কারোরই…
Powered by Froala Editor