সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ঘিরেই তোলপাড় দেশ জুড়ে। বারবার উঠে আসছে নেপোটিজম বা স্বজনপোষণের প্রসঙ্গ। স্বজনপোষণের মাধ্যমেই প্রতিভাবান এবং তরুণদের সাফল্যের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে ক্রমাগত। তবে এই জিনিস নতুন নয়। সীমাবদ্ধ নয় কেবলমাত্র চলচ্চিত্র জগতেই। আজ থেকে ঠিক চল্লিশ বছর আগে এই দিনেই আত্মহত্যাকে বেছে নিয়েছিলেন বাঙালি চিকিৎসক ডঃ সুভাষ মুখোমাধ্যায়। স্বীকৃতিহনন, অপমান এবং হয়রানি— জুড়ে আছে এই দিনটার নেপথ্যে।
কানুপ্রিয়া আগারওয়াল ওরফে ‘দুর্গা’। ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। ১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর দুর্গার জন্মের সঙ্গেই বিশ্বের দরবারে চিকিৎসাক্ষেত্রে ভারত জায়গা করে নিয়েছিল প্রথম সারিতে। অংশীদার হয়েছিল বিশ্বব্যাপী গর্বের। কারণ ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা টেস্ট টিউব বেবি-র গবেষণাক্ষেত্রে পৃথিবীতে এটিই দ্বিতীয় উদাহরণ। তার মাত্র ৬৭ দিন আগেই ব্রিটেনের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন জয় ব্রাউন। অন্যান্য উন্নত দেশগুলিও পিছিয়ে এই গবেষণায় এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে এমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে।
দুর্গার জন্মের পিছনে যার অনস্বীকার্য কৃতিত্ব ছিল, তিনি ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে তাঁর এই বিশ্বমানের গবেষণাকে কীভাবে গ্রহণ করেছিল বাঙালি? না, পুরষ্কার বা সম্মাননা তো দূরের কথা, বরং তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এই অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কারের স্বীকৃতিও। সমালোচনা, খোরাক আর অবহেলার বেড়াজালে আটকে ফেলা হয়েছিল তাঁর প্রতিভাকে। এই কলকাতার বুকেই কোণঠাসা হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন।
সরকারি আমলাদের স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই সংবাদমাধ্যমে এই গবেষণার কথা উল্লেখ করায় তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিল কাঠগড়ায়। তৎকালীন রাজ্য সরকারের তরফে ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর কিছু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল একটি তদন্ত কমিটি। যার সদস্যদের বেশিরভাগই অবগত ছিলেন না এই গবেষণার ব্যাপারে। সেই সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল ঈর্ষা এবং ক্ষমতাশালীদের প্রভাব। পরিকাঠামো, উপযুক্ত যন্ত্রাদি, প্রযুক্তি এবং বিপুল অর্থের অভাব সত্ত্বেও তাঁর অভাবনীয় এই কীর্তিকে অস্বীকার করেছিল সেই কমিটি। উদাসীন থেকে ছিল তাঁর কাজের প্রতি।
দুর্গার মায়ের শরীরে তিনি প্রয়োগ করেছিলেন যৌন হরমোনের। যা এর পূর্ববর্তী গবেষণায় কখনো ব্যবহৃত হয়নি। তারপর ভ্রুণ সংগ্রহ করে তরল নাইট্রোজেনে ৫৩ দিন আবদ্ধ রেখে হিমায়িত করেছিলেন তিনি। ভ্রুণকোষ গঠন হওয়ার পর তা আবার গর্ভে স্থাপন করেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে জেরায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আবদ্ধ রাখার পরও ভ্রুণের মৃত্যু হয়নি?’ যে প্রশ্ন কেবলমাত্র অপমান সূচক নয়, তা হাস্যকর। যা পরিচয় রাখে সমসাময়িক চিকিৎসকদের অজ্ঞতা, দ্বিচারিতা এবং রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির। ‘বোগাস’ আক্ষা দেওয়া হয়েছিল তাঁর গবেষণাপত্রকে। বলা হয় তাঁর এই গবেষণা এবং দাবি পুরোপুরি মিথ্যে। তাঁর থেকে এই কৃতিত্ব ছিনিয়ে, তা দেওয়া হয়েছিল মার্কিনি গবেষক হাওয়ার্ড জোন্সকে। পাশাপাশি জাপানের এক চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বক্তৃতার জন্য নিখরচায় নিয়ে যেতে চাইলে সেখানেও বাধা দেয় রাজ্য সরকার।
তবে শাস্তির শেষ এখানেই নয়। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁকে বদলি করা হল মেডিক্যাল কলেজে। যেখানে ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় হরমোন গ্রন্থির বিশেষজ্ঞ, সেখানে তাঁর ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিযুক্ত করা হল চক্ষুবিভাগে। হতাশা, অবসাদ, অপমানের ভারে ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছিল তাঁর মানসিক অবস্থা। বদলির চিঠি আসার মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই তিনি বেছে নেন আত্মহননকে। তাঁর স্ত্রী ও শিক্ষিকা নমিতা মুখোপাধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে এসে উদ্ধার করেছিলেন তাঁর মৃতদেহ। কিছুই করার ছিল না তখন আর।
আরও পড়ুন
‘কোচ’ সুশান্তের সঙ্গে আর দেখা হল না মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ক্রিকেটার দিগ্বিজয়ের
না। তাঁর মৃত্যু নিয়ে সারা রাজ্যে বা দেশে সাড়া পড়েনি কোনো। হয়নি প্রতিবাদ-ও। তাঁর মৃত্যুর ছ’বছর পর ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট টিউব বেবি, ‘হর্ষ’-এর জন্মের সময়, জন্মদাতা গবেষক আনন্দ কুমার সরব হয়েছিলেন তাঁর গবেষণা নিয়ে। প্রকাশ্যে এনেছিলেন ডঃ মুখোপাধ্যায়ের অবদান। পরবর্তীকালে সমস্ত নথী মিলিয়ে ২৫তম জন্মদিনে দুর্গা এক স্মৃতিসভায় জনসমক্ষে ঘোষণা করেছিলেন, মিথ্যা ছিল না সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা। এই স্বীকৃতি, বিচার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারলেন না তিনি। তাহলে হয়তো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হত না তাঁকে।
গত ৪০ বছরে উন্নত হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। গঠিত হয়েছে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো। এগিয়েছে আইভিএফের গবেষণাও। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে বর্তমানে তৈরি হয়েছে টেস্ট টিউব বেবি সেন্টারও। শুধু চিকিৎসার একটি কালো দিন হয়ে থেকে গেছে ১৯ জুন...
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সুশান্তের ভাবনাচিন্তা একত্রিত করতে নতুন ওয়েবসাইট, অভিনব শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুরাগীদের