একেকটা ছবি তো আসলে একেকটা দলিল। আমাদের চারপাশের এই পৃথিবীর আলো-আঁধারি মানচিত্রকে চিনিয়ে দেয় তারা। আর সেইসব ছবির আড়ালে থাকে একেকজন ফটোগ্রাফারের নিরলস অনুসন্ধানী মন। আর সত্যের অনুসন্ধানে যে পদে পদে বিপদ, সেকথা তো আমরা সকলেই জানি। একেকটি ছবিও তাই জীবন পর্যন্ত কেড়ে নেয়। তাঁদের বেশিরভাগের কথাই অবশ্য শেষ পর্যন্ত জানা যায় না। তবে অনেকে আবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার গল্পও শুনিয়েছেন। আবার অনেকের মৃত্যুর কথা জানা যায় পারিপার্শিক প্রমাণ থেকে। আসুন জেনে নেওয়া যাক তেমনই কয়েকজন ফটোগ্রাফারের কথা, ছবি তুলতে গিয়েই অবসান হয়েছে যাঁদের বর্ণময় জীবনের।
মাত্র কয়েকমাস আগের কথা। নভেম্বর, ২০১৯। করোনা ভাইরাস তখনও সারা পৃথিবীতে রাজত্ব শুরু করেনি। বনে-জঙ্গলে বন্য প্রাণীর খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন অনেক ওয়াইল্ড-লাইফ ফটোগ্রাফার। বাংলার আশিষ শিট ছিলেন তেমনই একজন। ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে পৌঁছে গেলেন হাতির সন্ধানে। দেখাও পেলেন। দূর থেকে কিছু ছবি তুললেন হাতির দলের। কিন্তু সেসব ছবি পুরোপুরি পছন্দ হয়নি। তিনি চাইলেন খুব কাছ থেকে হাতির দলের ছবি তুলতে। কিন্তু ৩৫ বছরের এই যুবকটির এমন দুঃসাহস পছন্দ হয়নি হাতির দলের। তাদের আক্রমণে পদপৃষ্ঠ হয়ে আহত হলেন আশিষ শিট। এরপর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। সেই একটি মনের মতো ছবি তোলার পরিতৃপ্তি নিয়েই শেষ হল তাঁর জীবন।
আরও পড়ুন
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি – হুজুগ, নিষ্ঠা ও কিছু বিপন্ন বন্যপ্রাণের গপ্পো
এর ঠিক তিন বছর আগে এমনই ঘটনা ঘটেছিল কেনিয়াতে। আসলে ওয়াইল্ড-লাইফ ফটোগ্রাফারদের জীবন যে সবসময় এক অনিশ্চয়তার সূত্রে বাঁধা। মৃত ব্যক্তির পরিচয় অবশ্য জানা যায়নি। কিন্ত তাঁর হাতের ক্যামেরা এবং তার মধ্যে শেষদিকে তোলা কিছু ছবি থেকে ঘটনাটা বিশদে বোঝা যায়। কেনিয়ার সাভো ন্যাশানাল পার্কে ঘুরতে ঘুরতে সেই ফটোগ্রাফার হঠাৎ দেখতে পান নদীর ধারে জল খাচ্ছে একদল দাঁতাল হাতি। কিন্তু সেদিকে যেতেই ঘুরে দাঁড়াল দাঁতালের দল। বিকেলের দিকে বনবিভাগের কর্মীরা পরিদর্শনে এসে খুঁজে পেলেন একটি মৃতদেহ। তার হাত তখনও ক্যামেরার শাটারে।
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম ফটোগ্রাফিক স্টুডিও কলকাতাতেই; ১৫৩ বছরের যাত্রায় দাঁড়ি টেনেছিল অর্থাভাব
আরও পড়ুন
১৩৭ বছর আগে তোলা এই ছবিই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফ
এই ঘটনাটি ঘটে ক্যালিফোর্নিয়ার লোডি শহরের। ৬৩ বছরের এই ফটোগ্রাফার অবশ্য ওয়াইল্ড-লাইফ ফটোগ্রাফার নন। বরং নাগরিক জীবনের ছবি তুলতেই তিনি হাজির হয়েছিলেন জিয়ন পার্কে। পার্কিং গ্যারেজের ৪০ ফুট উঁচু ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি নিচের ব্যস্ত জনতার ছবি তুলছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ অসাবধানতার কারণে ছাদ থেকে পড়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও ৪০ ফুট থেকে পড়ে যাওয়ার আঘাত সামলাতে পারলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেলেন তিনি।
আরেকজন নাগরিক ফটোগ্রাফার ভিক্টোরিয়া স্ক্যাফার। তবে তাঁর মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়। বরং পুলিশের ধারণা, স্ক্যাফারের মৃত্যু আসলে একটি খুন। গতবছর এপ্রিল মাসে আসন্ন শ্রমিক দিবস উপলক্ষে ছবি তুলছিলেন স্ক্যাফার। ওহিও শহরের ওল্ড-ম্যান্স কেভের সামনে একদল স্কুল পড়ুয়াকে নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন স্ক্যাফার। এমন সময় তাঁর মাথায় এসে পড়ল একটি গাছের মোটা ডাল। আর তারপরেই মারা যান তিনি। পুলিশ প্রথমে একে দুর্ঘটনা বলে মনে করলেও তদন্তে নেমে দেখা যায় সেখানে কোনো গাছ থেকে ডাল ভেঙে পড়ার কোনো সম্ভবনাই নেই। তারপর প্রায় ৬ মাস তদন্তের পর পুলিশ দুজন স্কুল পড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করে। জানা যায়, তাদের কিছু অসামাজিক কাজের ছবি তুলে ফেলেছিলেন স্ক্যাফার। আর ফটোগ্রাফারের পাশাপাশি শেফার্ড একজন সমাজকর্মী। তিনি যে এই ছবি তুলেই চুপ করে থাকবেন না, সেটাও বেশ বুঝেছিল দুটি ছেলে। আর তাই স্ক্যাফারকে ক্যামেরা হাতেই প্রাণ হারাতে হল।
ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেসনো শহরে ৫ বছর আগেই ঘটেছিল আরেকটি দুর্ঘটনা। ডাউনটাউন রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন একজন ফ্যাশান ফটোগ্রাফার। পিছনে ছিল ট্রেনের ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু কেউই খেয়াল করেননি, পাশের লাইন দিয়ে এগিয়ে আসছে আরেকটি ট্রেন। আর ছবি তুলতে তুলতে ফটোগ্রাফার এসে পড়লেন সেই লাইনেই। সঙ্গে সঙ্গে ঘটল দুর্ঘটনা। হাসপাতাল পর্যন্ত আর নিয়ে যাওয়া যায়নি।
তবে শেষ যে আলোক-শিল্পীর কথা বলব, তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি। খুনও হননি। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। ঘটনার কথা বলার আগে একটি ছবির কথা বলা যাক। আলোক-শিল্পের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ছবি। ‘নিউ-ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় এই ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’ নামে। যদিও ছবিতে দেখা শিশুটি সম্ভবত একটি বালক। তবে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত আফ্রিকায় তখন বালক বা বালিকার আর প্রভেদ কোথায়? সকলের চিন্তাই শুধু সামান্য কিছু খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা। এমনই একটা মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে মাঠের মধ্যে বসে থাকা শিশুটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে একটি শকুনি। যেন অপেক্ষায় আছে কখন শিশুটি মারা যাবে। আর এই ছবির পিছনের শিল্পীর নাম কেভিন কার্টার। মানুষের এমন দুর্দশাগ্রস্ত সময়ের ছবি তোলার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন তিনি। তবে এই শেষ ছবির অভিঘাত সহ্য করতে পারলেন না কেভিন। আর তাই এই ছবি বিখ্যাত হওয়ার, এমনকি পুরস্কৃত হওয়ার পরেও কেভিনের মনে হতে থাকে তিনি যেন অর্থের বিনিময়ে দারিদ্র্যকে বিক্রি করছেন। আর তাই ১৯৯৪ সালের ২৭ জুলাই নাকের সামনে কার্বন-মনোক্সাইড পাইপ ধরে রেখে নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলেন বিষ। আর রেখে গেলেন তাঁর শেষ সময়ের অনুভুতির কথা। হুবহু তুলে দেওয়া হল তাঁর সেই সুইসাইড নোট –
“I'm really, really sorry. The pain of life overrides the joy to the point that joy does not exist. ...depressed ... without phone ... money for rent ... money for child support ... money for debts ... money!!! ... I am haunted by the vivid memories of killings & corpses & anger & pain ... of starving or wounded children, of trigger-happy madmen, often police, of killer executioners ... I have gone to join Ken if I am that lucky.”