জলের নিচে দম বন্ধ করে ১৩ মিনিট! কীভাবে পারে এই সম্প্রদায়?

একবার দম নিয়ে, পুকুরের জলে কে কত বেশিক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে— শহর থেকে একটু দূরে অবস্থিত গ্রাম কিংবা মফস্বলের দামাল কিশোরদের হামেশাই দেখা যায় এমন আশ্চর্য খেলায় অংশ নিতে। কিন্তু কতক্ষণ? ৪০ সেকেন্ড, ৫০ সেকেন্ড, বা বড়োজোর ১ মিনিট। জলের নিচে তার বেশি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ধরে রাখা বেশ কঠিন দুঁদে ডুবুরির ক্ষেত্রেও। কিন্তু অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই যদি একটানা ১২-১৩ মিনিট কোনো মানুষ দম ধরে রাখতে পারেন জলের তলায়? 

শুনে অবাক হলেন নিশ্চয়ই? অসম্ভব মনে হলেও, এমনই আশ্চর্য ঘটনা ক্ষমতার অধিকারী বাজাউ লাউতরা। ‘বাজাউ লাউত’ (Bajau Laut) আসলে একটি বিশেষ যাযাবর জনগোষ্ঠী। সাধারণ মানুষের ভাষায় তাঁরা পরিচিত ‘সমুদ্র জিপসি’ নামেও। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিনসে মূলত বাসবাস এই বিশেষ সম্প্রদায়ের। আর এই জনগোষ্ঠীর প্রায় সমস্ত মানুষই ১২-১৩ মিনিট শ্বাস ধরে রাখতে পারেন জলের নিচে। একবার দম নিয়েই ডুব দিতে পারেন সমুদ্রে। দীর্ঘক্ষণ কাটাতে পারেন ২০০ ফুট গভীর জলে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে সম্ভব এমনটা? 

এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে, বাজাউ লাউত সম্প্রদায়ের লোককথা সম্পর্কে খানিক বলে নেওয়া প্রয়োজন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই সম্প্রদায়ের মানুষরা আসলে মালয়েশিয়ার শহর জোহরের বাসিন্দা। আজ থেকে কয়েকশো থেকে হাজার বছর আগে তাঁরা বসবাস করতেন সেখানে। সেখানে তখন রাজার শাসন। ভয়াবহ এক বন্যার শিকার হয়েছিল গোটা অঞ্চল। তাতে একদিকে যেমন বহু মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন, তেমনই স্রোতে ভেসে যান রাজ্যের খোদ রাজকুমারী। যেভাবেই হোক জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে তাঁর দেহ, শোকাহত রাজা আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর খাস কর্মচারীদের। রাজার কথা মেনেই তাঁরা ছোট্ট ডিঙিতে চেপে পাড়ি দিয়েছিলেন সমুদ্রে। না, রাজকুমারীর দেহ খুঁজে পাননি তাঁরা। এই ব্যর্থতার লজ্জায় আর দেশেও ফেরেননি। মুখ দেখাননি রাজাকে। সেই থেকে সমুদ্রযাপনের শুরু। 

এই কিংবদন্তি সত্যি কিনা তা বলা মুশকিল। তবে মজার বিষয় হল, আজও বাজাউ লাউতরা বসবাস করেন সমুদ্রেই। ঘর বলতে তাঁদের ছোট্ট নৌকা। ৫ মিটার বাই দেড় মিটারের এই নৌকোতেই বসবাস করেন তাঁরা। সেখানেই থাকা, খাওয়ার বন্দোবস্ত। হাজার ঝড়-ঝঞ্ঝাতেও সমুদ্র ছেড়ে তিরে ভেড়েন না তাঁরা। স্থলভূমির সঙ্গে তাঁদের কেবলমাত্র ব্যবসায়িক যোগ। কিন্তু কীসের ব্যবসা করেন তাঁরা?

আসলে জন্ম থেকেই মাঝ-সমুদ্রে বেড়ে ওঠা বাজাউ লাউতদের। ফলে, সামুদ্রিক পরিবেশকে তাঁদের থেকে ভালো চেনেন না কেউ-ই। পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ শ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা থাকায় এই সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষই দক্ষ ডুবুরি। আর সেটাই তাঁদের পেশা। গভীর সমুদ্র থেকে মাছ, কাঁকড়া শিকার করার সময় তাঁরা সংগ্রহ করে আনেন মৃত কোরাল, অর্থাৎ প্রবাল। রত্ন হিসাবে যা বিক্রি হয় মোটা দামে। তাছাড়া স্কুবা-ডাইভার হিসাবেও কাজ করেন এই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ। কেউ আবার মাছ শিকার করে তা জলের দরে বিক্রি করেন মূল ভূখণ্ডের মাছ বিক্রেতাদের কাছে। 

বাজাউ লাউতদের এই আশ্চর্য ক্ষমতা নব্বই দশকের গোড়া থেকেই নজর কেড়েছিল পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের। শুরু হয়েছিল নানান গবেষণা। সেখানে থেকেই উঠে আসে, আসলে শতাব্দীর পর শতাব্দী সমুদ্রযাপনের ফলে, ক্রমে জিনগতভাবে অভিযোজিত হয়েছে তাঁরা। দীর্ঘায়িত হয়েছে তাঁদের প্লীহা। প্লীহার এই গঠনের কারণে বেশিক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে পারেন তাঁরা। অনেকটা অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মতোই। পাশাপাশি প্লীহা নিয়ন্ত্রণ করে শরীরে লোহিত কণিকার পরিমাণ। বেশি পরিমাণ লোহিত কণিকা উৎপন্ন হওয়ায়, এক দমে বেশি পরিমাণ অক্সিজেনও ফুসফুসে ভরে নিতে পারেন বাজাউ লাউতরা। গবেষকদের নজর কেড়েছে, তাঁদের ফুসফুসের আকার, ডায়াফ্রেমের দৃঢ়তাও। তবে ঠিক কী কারণে এই অভিযোজন— তা এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেননি গবেষকরা। 

তবে এখানেই শেষ নয়, দীর্ঘক্ষণ সমুদ্রে ডুব দেওয়ার জন্য কম কসরতও করেন না বাজাউ লাউতরা। অল্প বয়সে নিজেরাই ফাটিয়ে ফেলেন নিজেদের কানের পর্দা। তাতে কানের মধ্যে জল জমে সংক্রমণের আশঙ্কা কমে ঠিকই, তবে ষাটের গণ্ডি পেরোলেই শ্রবণশক্তি হারান অধিকাংশ মানুষ। তবে এটাই ক্রমে রীতি হয়ে গেছে বাজাউ লাউত সমাজের। 

সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিন্সের সমুদ্রে দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে মানব-সভ্যতার। ক্রমশ সমুদ্রের দখল নিচ্ছেন বড়ো বড়ো বিজনেশ টাইকুনরা। মৎস্যশিকারের জন্য সমুদ্রে ট্রলারের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহারেও ক্রমে মাছের সংখ্যা কমছে, কমছে প্রবালপ্রাচীরের পরিমাণও। ফলে ধীরে ধীরে জীবিকা হারাচ্ছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সামুদ্রিক নোমাডরা। অনেকেই সমুদ্রজীবন ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাধ্য হয়েছেন অন্য জীবিকার পথে হাঁটতে। ফলে বছর বছর কমেই চলেছে সমুদ্রবাসী বাজাউ লাউতদের সংখ্যা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, স্থলভাগে যাঁরা বসতি স্থাপন করেছেন, আজও তাঁদের কোনো দেশেরই নাগরিকত্ব মেলেনি। সম্পূর্ণ উদ্বাস্তুদের মতোই বেঁচে আছেন তাঁরা। এমনকি দেশের জনগণনাতেও সামিল করা হয় না তাঁদের। কেবলমাত্র কিছু আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাই পরিসংখ্যান রাখেন এই সমুদ্রবাসী যাযাবরদের! এও এক আশ্চর্য ঘটনাই বটে…

Powered by Froala Editor