আজ থেকে ৭০ বছর আগেও গুহায় বাস করত ‘লজ্জা’র শহরের বাসিন্দারা

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তৈরি একটি শহর। যার মাঝখানে এক বিশাল ফাঁকা জায়গা। প্রাচীনত্বের ছাপ সর্বত্র। প্রায় ৯০০০ বছর পুরনো এই শহর। অবশ্য পৃথিবীতে প্রাচীন শহরের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক হয়ে উঠেছে প্রতিটি সভ্যতা। কিন্তু ইতালির (Italy) সাসি ডি মাতেরার (Saasi Di Matera) বিষয়টি আলাদা। একটা সময় পর্যন্ত এই শহরের অধিকাংশ মানুষই থাকত গুহার মধ্যে। না, আদিম সভ্যতার কথা হচ্ছে না। মাত্র ৭০ বছর আগেও এভাবেই জীবনযাপন চলত তাদের। এখনও বহাল তবিয়তে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বিরাজ করছে এই গুহাগুলি।

ইতালীয় ভাষায় ‘সাসি’ শব্দের অর্থ পাথর। সেই সূত্রে এই শহরের নাম হতে পারে মাতেরার পাথরবাড়ি। একেবারেই সার্থক নাম। দক্ষিণ ইতালির বাসিলিকাতা প্রদেশে এর অবস্থান। পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা সরু-সরু গলিতে এখন বাড়িতে থাকে ৬০০০০-এর কাছাকাছি মানুষ। যদিও, এই বাড়িগুলি গড়ে উঠেছে অনেক পরে, আসল আকর্ষণ গুহাবাড়িগুলি নিয়ে। প্যালিওলিথিক যুগের মানুষরা থাকত এখানে। যুগ বদলালেও মাতেরার জনজাতিরা বাসস্থান পরিবর্তন করেনি। বরং পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করেছে নতুন নতুন গুহা। আর সেই বসবাস চলেছিল ১৯৫০ পর্যন্ত।

অবশ্য পাশাপাশি গড়ে উঠছিল ‘সভ্য’ মানুষের ঠিকানা। কিন্তু দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে কেই-বা আসে ভ্রমণ করতে? ফলে গোটা ইতালির কাছেই একপ্রকার অবহেলিত ছিল মাতেরা। আঠারো শতকের শেষ দিকে কিছু সাহসী অভিযাত্রী ‘আবিষ্কার’ করে অঞ্চলটিকে। শহুরে ছোঁয়া লাগে অল্পবিস্তর। প্রতিষ্ঠিত হয় গির্জা আর চ্যাপেল। তবুও গুহা থেকে বের করা যায়নি সেই অঞ্চলের মানুষদের। ইতালির প্রশাসনও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি তাদের জন্য। এবোলি পর্যন্ত এসে ঘুরে যায় রেলপথ আর লুজানিয়াতে এসে থেমে যায় রাস্তার কাজ। ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক সব দিক থেকেই পিছিয়ে থাকে মাতেরা। অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রায় ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে মানুষের জীবন। সঙ্গে নিত্যনৈমিত্তিক দারিদ্র্য। 


আরও পড়ুন
চিনের গুহায় লুকানো হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি, ডুনহুয়াং-এর আশ্চর্য ইতিহাস

এভাবেই চলে আসে মুসোলিনির আমল। মাতেরার বাসিন্দারা জীবনযাত্রা পরিবর্তনের বিষয়ে তখন সক্রিয় হয়ে উঠলেও বাধ সাঁধে ফ্যাসিস্ট শাসন। বাইরে থেকে যেটুকু শস্য ও চিকিৎসার সরঞ্জাম পৌঁছোত, তাও বন্ধ হয়ে যায় ক্রমে। বিদ্যুৎ নেই, শুদ্ধ জলের ব্যবস্থা নেই, এমনকি একটা দোকান পর্যন্ত নেই গোটা শহরে। তার সঙ্গে ছিল ম্যালেরিয়ার উপদ্রব। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, সরকার থেকে মাতেরাকে বকলমে ঘোষণা করা হয় ‘ইতালির লজ্জা’ (The Shame of Italy) বলে। সেই সময়ে শহরের পরিস্থিতি ও মুসোলিনি সরকারের অবহেলার বিবরণ পাওয়া যায় ইতালীয় ডাক্তার কার্লো লেভির (Carlo Levi) লেখায়। তাঁর বইয়ের নাম ‘ক্রাইস্ট স্টপড অ্যাট এবোলি’। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যথেষ্ট পরিচিতি ছিল কার্লোর, ফ্যাসিস্ট সরকারের কোপে পড়ে নির্বাসন দেওয়া হয় লুজানিয়াতে। তারপর মাতেরার গুহাবাসী মানুষদের উন্নতির জন্য জীবনের অনেকটা সময় কাটান তিনি। 

আরও পড়ুন
টি-রেক্সের কঙ্কাল থেকে হ্যারির জাদুছড়ি— ইতালির ‘গোপন’ গ্যালারিতে মেলে সবই!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও যে নতুন প্রশাসন এ বিষয়ে ভালো পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা নয়। বরং ১৯৫০ সালে ঘোষণা করা হয়, মাতেরার মানুষদের অবিলম্বে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। প্রতিবাদ জানায় তারা, কয়েক হাজার বছরের বাসস্থান ছেড়ে ‘উদ্বাস্তু’ হতে রাজি নয় কেউই। পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও খুব স্পষ্ট করে বলা হয়নি সরকারের তরফ থেকে। শেষ পর্যন্ত জোর করে তুলে দেওয়া হয় তাদের। ৯০০০ বছরে প্রথমবারের জন্য শূন্য হয়ে যায় শহরটি। 

১৯৬০-এ অবৈধ ঘোষণা করা হয় গুহাবাসের প্রথাকে। সেই থেকে দীর্ঘদিন শূন্য হয়েই পড়েছিল মাতেরার গুহাগুলি। আবারো এগিয়ে আসেন কার্লো। সরকারের কাছে আবেদন পেশ করেন ঐতিহাসিক শহরটিকে সংরক্ষণ করে পর্যটনকেন্দ্র রূপে গড়ে তোলার জন্য। তারপর নতুন করে সেজে ওঠে মাতেরা। গুহাগুলিকে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক হোটেল হিসেবে। ১৯৯৩ সালে ইউনেসকো-র ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমাও পায় মাতেরা। যা ছিল একসময়ে ইতালির ‘লজ্জা’, আজ তার গুহাঘরের সৌজন্যে আশ্চর্য এক ইতিহাসের মুখোমুখি পর্যটকরা।

Powered by Froala Editor