‘পারসিল দ্যাশভাগ আটকাইতে? অহন আবার মানুষরে ঘরছাড়া করার মতলব...’

‘বক্তিয়ার-শাহ’ রোডের বাড়িটার সামনে থমকে দাঁড়াল একটা ঘোড়ার গাড়ি। গাড়ি থেকে মাল নামাচ্ছিলেন  কাঁচাপাকা চুলের একজন প্রৌঢ়, এক অল্পবয়সী যুবক, একজন স্ত্রীলোক। পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন ওপার থেকে। ভিটেমাটি হারিয়ে। বাবার ‘কানাইজেঠু।’ ঠাকুমা ঠাকুর্দার চাপা আপত্তি সয়েও তাঁরা ‘বক্তিয়ার শাহ রোডে'র -এর সেই বাড়িতে আস্তানা গেড়েছিলেন বেশ কয়েকদিন। এই ‘ উড়ে এসে জুড়ে বসাকে’ ভালো চোখে নেয়নি কেউ। আমার প্ৰপিতামহী অর্থাৎ বড়ঠাকুমা-কে বাদ দিয়ে।

‘আমাগো বাসার পাশে কানাইদের বাসা ছিল...অরে হামা দিতে দ্যাখসি।’
আমার বড়ঠাকুমা শক্তধাতের মানুষ ছিলেন। কঠোর। তাঁর কথার উপর কথা চলত না। দাদু- ঠাকুমা তাই এই ‘অত্যাচার' মুখে মেনে নিয়েছিলেন নিরবে। কিন্তু আদৌ মানতে পেরেছিলেন কী? পাঁচজনের পরিবারে আরো বাড়তি তিনজন যোগ হল। সংসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উটকো ঝামেলা। এই চাপা বিদ্বেষ সর্বদা এটুলির মতো সেঁটে ছিল অনাহুত অতিথিদের উপর। কানাইজেঠুরাও তাই ক'দিন বাদেই চলে গেলেন আজাদগড়ের কলোনিতে…

একটা গল্প বাবা মাঝে মাঝে বলেন। সবাই বিকেলে চা নিয়ে বসেছিলেন। ঘরের পরিবেশ ভারী। বাবাও ছিলেন আশেপাশে। তখন তিনি নেহাতই ছোটো। গল্প করতে করতে একসময়ে বড়ঠাকুমা কানাইজেঠুর মেয়েদের প্রসঙ্গ পাড়লেন। তারা নাকি ওপারেই রয়েছে।
‘মাইয়াগুলার শুনছি বিয়া হয়ে গেসে!’
‘হ’
কেমন যেন থুম মেরে যান প্রৌঢ়। তারপর হঠাৎ ডুকরে ওঠেন কান্নায়,
‘রাখতে পারলাম না...তুইল্যা নিয়া গেল..’

দাদুকে জীবদ্দশায় বাঙাল বলতে দেখিনি। ফরিদপুরের মাদারীপুর সাবডিভিশনের গ্রাম থেকে দাদু ভর্তি হয়েছিলেন বঙ্গবাসীতে। দেশভাগের আগেই। কলকাতা দাদুকে শিখিয়েছিল সাহেবি কেতা-কায়দা। বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছিল স্বদেশের বুলি। দাদু ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে ম্যাকবেথ আওড়াতেন। আসলে এই সাহেবিয়ানাও হয়তো একাধিক বাঙালবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাওয়া যাবে। তাই খবরের কাগজ অনায়াসে হয়ে যায় ‘পেপার।’ মাখন--‘বাটার'। তাছাড়া দাদু চিরকাল ‘গুহ-বংশ’ নিয়ে স্পর্শকাতর। কেউ ‘গুহ’ হিসেবে পরিচয় দিলে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তা কোথাকার গুহ? বরিশাইল্যা না ফরিদপুর?’ বরিশাল শুনলেই ভুরু কুঁচকে যেত দাদুর। বরিশালের লোকেরা নাকি ভয়ঙ্কর ঝগড়াটে আর মামলাবাজ…

আরও পড়ুন
পরিবেশের কারণে উদ্বাস্তু, শিকড় ছিঁড়ছে আলাস্কার অধিবাসীদের

বাঙাল নিয়ে একটা পরিচিত রসিকতা শুনতে পাওয়া যাবে এদেশীয়দের মুখে মুখে। ‘ওদেশে আমাগো বিঘা বিঘা ধান জমি আছিল।’ যেন সকলেই জমিদার। দেশভাগের আগে যেন সকলেরই গোয়ালে আট-ন'টা গরু, তিন-চারটে পুকুর, গোলাভর্তি ধান ছিল। সব নাকি ফেলে চলে আসতে হয়েছে। এই রসিকতাও আসলে কিয়দংশ সত্য। বাবার সেই দুঃসম্পর্কের আত্মীয়রদের কথাই যেমন মিলে যায়। দেশভাগের পর এককাপড়ে চলে আসেন গড়ফা কলোনিতে সুদীপ্ত কাকারা। ওদেশে নাকি তাঁদের ‘বিরাট সম্পত্তি’ পড়ে আছে। অথবা তা বেহাত হয়ে গিয়েছে অচিরেই। এই দক্ষিণ কলকাতাতে টেনেটুনে একটা কাপড়ের দোকান দাঁড় করিয়েছিলেন সুদীপ্তকাকার বাবা। সেটাও বেশিদিন চলেনি…

৪৭-এর পর থেকে ৬০-এর দশকের গোড়া অবধি ট্রেনবোঝাই মানুষ আসত কলকাতায়। ৭১-এর পর আবার শুরু হয়, এই ‘চলে আসা'। প্রথম প্রথম যাদবপুর তারপর ক্রমে বিক্রমগড়, আজাদগড়, বিজয়গড়, কাটজুনগর…

আরও পড়ুন
ভিটেমাটি হারিয়ে আবার উদ্বাস্তু জীবন? বাংলায় বাড়ছে এনআরসি-আতঙ্ক

যেখানে আমার বেড়ে ওঠা সেই বাড়িটার পাশেই কলোনি। দাদু রাগারাগি করতেন। ‘কলোনির ওদের’ নাকি শিক্ষাদীক্ষা নেই। গ্রাম্য স্বভাব। সব ব্যাপারে কৌতূহল। বাবা-কাকারা বেরোলেই পাশের বাড়ি থেকে আওয়াজ আসত, ‘কই যাস?’ বাবারা কায়দা করে এড়িয়ে যেত। ‘এই এ'দিকে যাচ্ছি!’ একদিন কাকার বেরোবার রাস্তা আটকে দাঁড়ায় পাশের বাড়ির এক দাদা। ‘কই যাস?’ বলতেই হবে। শেষে সত্যিটা বলে কাকা সেযাত্রা পরিত্রাণ পেয়েছিল। 

খেলতে খেলতে কোনো খেলনা ছাত থেকে কলোনিঘরে পড়ে গেলে তা ফেরৎ পাবার আশা খুব ছিল না। তবে অধিকাংশই পেয়ে যেতাম আমি। ‘ভূপেনবাবুর নাতি' হিসেবে সকলেই চিনত পাড়ায়। ‘আমাগো ফরিদপুরের ভূপেনবাবু’। দাদু পাড়ার সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে রাখলেও আমার প্রতি এই মানুষগুলোর ব্যবহারে তার কোনো রেশ এসে পড়েনি।

আরও পড়ুন
সুন্দরবন ডুবছে, জল ফুরোচ্ছে আর বিশ্ব জুড়ে ভিড় বাড়ছে 'জলবায়ু উদ্বাস্তুদের'

বিদেশ বিভূঁই-এ জুড়ে জুড়ে থাকা। আত্মীয়তা। ফরিদপুর-ঢাকা-ময়মনসিংহ-উলপুর-ঈশ্বরপুর…

৪৭-এ ভাগ হয়ে গিয়েছিল ভূখণ্ড। কিসের ভিত্তিতে হয়েছিল তা সকলে হয়তো জানে। এই ‘বাঙাল-যাপনে'র মধ্যে দপদপিয়ে বেঁচে আছে ভিটে হারানোর বেদনা। যখন পাড়ার ক্লাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হত, তখন জাতীয় সঙ্গীতের সুরে ঝটকায় উঠে দাঁড়াতেন শীর্ণ সুবলদাদু। কেঁদে ফেলতেন। ঝরঝর করে…

সেলিমপুরের কলোনি ছেড়ে বছর ন'য়েকের আমি চলে এসেছিলাম যাদবপুরে। ফেলে এসেছিলাম মলিন হয়ে যাওয়া ছবি, রংচটা টিনের গাড়ি। এও এক ‘চলে আসা’। ন'টা বছর এখন ঝাপসা। শুধু আজকের দিনটা এলেই সবটুকু কেমন অন্ধকার লাগে। ভাষণ শুনি, ‘নাগরিকতা দেওয়া হবে উদ্বাস্তুদের।' প্রথমে গা গুলিয়ে ওঠে। পরে খুব হাসি পায়। 

মনে পড়ে, গৌতমজেঠুদের সঙ্গে একবার একটা বিয়েবাড়িতে দেখা হয়েছিল। জোর রাজনৈতিক তর্জা চলছে। একসময় রাগে চিৎকার করে ওঠেন জেঠু।

‘পারসিল দ্যাশভাগ আটকাতে? পারসিল? অহন আবার করব্যা? মইরা গেসি-বাঁইচ্যা আসি সরকার তহন জানতে আসিল? আমাগো বাবা মুখের রক্ত তুইল্যা মইরা গেল...তহন কোথায় ছিল এরা? আবার মানুষরে ঘর ছাড়া করার মতলব…’

স্বাধীনতা দিবস দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তো আনন্দের। কিন্তু আমাদের মতো ভূঁইফোড়দের কাছে? বড় যন্ত্রণার...

Powered by Froala Editor