সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই

ইতালির ভেনিস বন্দরের কাছেই যাত্রী পরিবহনের জন্য বিশেষ একটি বন্দর রাগুসা। যাত্রী এসেছেন নানা দেশ থেকে, জাহাজ ভর্তি করে। তবে হঠাৎ জানা গেল, কোনো যাত্রীই জাহাজ থেকে নামতে পারবেন না। অন্তত ৩০ দিন বন্দি হয়ে থাকতে হবে জাহাজে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরাও যেমন নামতে পারবেন না, তেমনই স্থানীয় কোনো মানুষও জাহাজের আশেপাশে ঘেঁষতে পারবেন না। যদি কেউ এই নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাহলে তাকেও ৩০ দিন বন্দি হয়ে থাকতে হবে। ৩০ দিনের আইন, তাই এই আইনের নাম ট্রেন্টিনো।

মনে হতে পারে, হঠাৎ এমন আইন কেন! তাহলে আরও কিছু বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অক্টোবর মাস, ১৩৪৩। কৃষ্ণসাগর থেকে সিসিলির মেসিনা বন্দরে এসে ভিড়ল ১২টি জাহাজ। যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত স্থানীয় মানুষরাও। কিন্তু জাহাজের কাছে যেতেই চমকে গেলেন সবাই। বেশিরভাগ যাত্রীই মৃত। আর জীবিতদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সারা শরীর থেকে রক্ত আর পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে। এই খবর পাওয়ামাত্র সমস্ত জাহাজকে ফিরে যেতে আদেশ দেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, ততক্ষণে হয়ে গিয়েছে। ইউরোপে ঢুকে গিয়েছে বুবোনিক প্লেগ। কৃষ্ণসাগর থেকে এসেছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত, তাই অনেকে বলেন 'ব্ল্যাক ডেথ'। এমন ভয়াবহ মহামারী ইউরোপের মানুষ ইতিপূর্বে দেখেনি। দশকের শেষ তিন বছরেই ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারায়। আর তারপর বহু প্রচেষ্টা করেও থামানো যায়নি এই সংক্রমণ।

নিতান্ত বাধ্য হয়েই, ১৩৭৭ সালে ট্রেন্টিনো আইন পাশ করে রাগুসা বন্দর কর্তৃপক্ষ। কীভাবে এই রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তা নিয়ে অবশ্য কোনো ধারণা ছিল না তখনও অবধি। কিন্তু মানুষের স্পর্শ থেকেই যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তেমনটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তাঁরা। প্লেগের দাপট চলেছিল আরও ৮০ বছর। এর মধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করে ফেলেছিল এই আইন। ইতালির অন্যান্য বন্দরেও এইধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকে। তার মধ্যে ছিল ভেনিস, পিসা, জেনেভা। অনেক জায়গায় আবার ৩০ দিনের সময়সীমা বাড়িয়ে ৪০ দিন করা হয়েছিল। ফলে নাম বদলে গিয়ে হয় 'কোয়ারেন্টিনো'। এই কোয়ারেন্টিনো থেকেই কোয়ারান্টাইন শব্দের উৎপত্তি।

কিছুদিন হল করোনার দাপটে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই 'কোয়ারান্টাইন' শব্দটি। প্রায় ৭০০ বছর পর আবার ফিরে এসেছে সেই আইন। প্রতিটি দেশেই এখন বিদেশিদের জন্য এবং বিদেশ থেকে ঘুরে আসা মানুষদের জন্য কড়া ব্যবস্থা। এই ৭০০ বছরেও অবশ্য একাধিকবার একাধিক জায়গায় এমন আইন লাগু হয়েছে। ১৭৯৩ সালে পীতজ্বর রুখতে ফিলাডেলফিয়ার নাবিকদের জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ১৮৯২ সালে আমেরিকায় টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়লে প্রায় ৭০ জন আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোয়ারান্টাইনে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। ২০০৩ সালে কানাডায় ছড়িয়ে পড়ে সার্স রোগ। তখন প্রায় ৩০,০০০ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টরন্টো দ্বীপে। তবে এখন আর ৩০ দিন বা ৪০ দিনের আইন নেই। শুধু নামটা থেকে গিয়েছে।

আবার ৩০ দিনের আইন কেন ৪০ দিন করা হয়েছিল, সেই প্রশ্নেরও কোনো সঠিক উত্তর জানা নেই। হয়তো ৩০ দিনে সংক্রমণ আটকানো যাচ্ছিল না বলেই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল। আবার এর পিছনে অনেকে বাইবেলের প্রভাবের কথাও বলে। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের কাছে ৪০ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংখ্যা। মৃত্যুর আগে মরুভূমিতে যীশু উপবাস করেছিলেন ৪০ দিন। ঈশ্বরের কাছ থেকে দশটি নির্দেশ পেতে ৪০ দিন অপেক্ষা করেছিলেন মোজেস। আর মহামারীর সঠিক কারণ জানা না থাকায় সেখানেও তো নানান ঐশ্বরিক ঘটনার কথা কল্পনা করতেন মানুষ। সেই কারণেও ৪০ দিনের আইন শুরু হতে পারে।

কারণ যাই হোক। নানা সময়ে নানা রোগের সংক্রমণ আটকাতে এমন নির্বাসনের নিয়ম নেওয়া হয়েছে। আর তা কাজেও এসেছে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের দাপটে সেইসব মহামারীর স্মৃতি উস্কে দিয়ে যায়। সেইসঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি শব্দ, 'কোয়ারান্টাইন'। করোনা আটকাতে এখনও কোনো চিকিৎসা বা প্রতিষেধক কিছুই আবিষ্কার হয়নি। অতএব মানুষের একমাত্র ভরসা সেই 'কোয়ারান্টাইন'।

More From Author See More