গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য কোয়ার্টার, ছোটো-বড়ো বাড়ি, ফ্ল্যাট। ইট-পাথর-কংক্রিটে সাজানো একটা শহর। আর এই ঘিঞ্জি জনবসতির মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে এক সুবিশাল বাগান। আকার একটু লম্বাটে হলেও আয়তন প্রায় প্রমাণ সাইজের ফুটবল স্টেডিয়ামের সমান। এমন ঘিঞ্জি শহরের চরিত্রের সঙ্গে এই বাগান একটু বেমানানই বটে। তবে এই বাগানই বাঁচিয়ে রেখেছে শহরের অসংখ্য মানুষকে। হয়ে উঠেছে তাঁদের ত্রাতা।
ব্রাজিলের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র রিও ডি জেনেইরোর (Rio De Janeiro) সমুদ্রতট এবং পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত ম্যাঙ্গুইনহোসে (Manguinhos) দেখা মিলবে এই বাগানের। তবে দু’দশক আগেও তার অস্তিত্ব ছিল না কোনো। বরং, সবুজে ঢাকা এই গোটা অঞ্চলটি ছিল আবর্জনার স্তূপ। অস্বাস্থ্যকর, দুর্গন্ধময় এই পরিবেশেই চলত মাদক-ব্যবহারকারীদের ব্যবসা। সেখান থেকে কীভাবে সঞ্জীবনী ফিরে পেল এই আস্তাকুঁড়? কেনই বা স্থানীয়দের কাছে ‘সেভিয়র’ হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠল এই বাগান?
২০০৬ সালের কথা। রিও পৌরসভার কৃষিবিদ জুলিও সিজার ব্যারোসের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল একটি বিশেষ প্রকল্প। পরীক্ষামূলকভাবে আবর্জনাস্তূপকে কৃষিক্ষেত্রে পরিণতকরতে চেয়েছিলেন তিনি। ম্যাঙ্গুইনহোসের এই ডাম্পিং গ্রাইন্ড তো বটেই, পাশাপাশি স্থানীয় স্কুলের পরিত্যক্ত মাঠ ও অসংরক্ষিত অঞ্চলগুলিকে পরিষ্কার করে সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে সবজির চাষ শুরু করেন সিজার। চাষের জন্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলি তাঁকে ব্যবহার করার অনুমতি দিলেও, সেইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি পুরসভা। তবে তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাঁর। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড়ো অংশ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন এই আবর্জনার স্তূপ পরিষ্কার করতে। পরবর্তীতে যৎসামান্য বেতনে কৃষিকাজের দায়ভারও গ্রহণ করেন তাঁরাই। আর সেখানে উৎপাদিত ফসল?
না, সেগুলি বিক্রি বা রপ্তানি করা হয় না। সেইসব শাক-সবজি বিনামূল্যেই তুলে দেওয়া হয় শহরের দরিদ্র মানুষদের হাতে। বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে এটাই হয়ে উঠেছে সেখানকার রীতি। এর ফলে উপকৃত হন প্রায় দশ হাজারের বেশি পরিবার। অন্যদিকে স্থানীয়দের অন্নসংস্থান হওয়ায় অনেকটাই কমেছে মাদকসেবন এবং মাদকচক্রে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা।
২০২০ সালে ব্রাজিল তথা ল্যাটিন আমেরিকার বৃহত্তম ‘নাগরিক বাগান’ বা ‘আর্বান গার্ডেন’-এর খেতাব পায় ‘হোর্টাস ক্যারিওকাস’-খ্যাত এই বাগানটি। এই বাগানের খ্যাতি ব্রাজিলের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ার পর নড়ে চড়ে বসে সে-দেশের সরকারও। ২০২১ সালে রিও প্রশাসন ঘোষণা করে, তিন বছরের মধ্যে এই বাগানকে বিশ্বের বৃহত্তম ‘আর্বান গার্ডেন’-এ পরিণত করার কথা। তা বাস্তবায়িত হলে বিনামূল্যে শাক-সবজি পাবেন প্রায় ৫০ হাজার পরিবার। পাশাপাশি উৎপাদনের অর্ধেক অংশ রপ্তানি করা হবে অন্যত্র। তাতে বাড়তি আয়ও ঢুকবে দেশের কোষাগারে। সবমিলিয়ে জুলিও সিজারের এই মস্তিষ্কপ্রসূত বাগান যেন ঘুরে দাঁড়ানোর দিশা দেখাচ্ছে দরিদ্র শহরটিকে…
Powered by Froala Editor