‘স্পাই’ (Spy)— শব্দটা শুনলেই যে-কোনো সিনেমাপ্রিয় মানুষের চোখের সামনে ভেসে জেমস বন্ডের নাম। মাথায় ঘুরতে থাকে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫ বা এমআই৬-এর কথা। বন্দুক চালনা থেকে শুরু করে হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড কমব্যাট, শত্রুশিবিরের গোপন তথ্য ঘেঁটে বার করা বা উদ্দাম যৌনতা-নারীসঙ্গ— সবকিছুতেই পারদর্শী তিনি। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই এমন হয় স্পাইদের জীবন? শুধুই কি জাতীয়তাবাদের জন্যই এমন একটা জীবনকে আঁকড়ে ধরা যায়, যেখানে প্রতিটা বাঁকে অপেক্ষা করে থাকে প্রাণের ঝুঁকি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ফিরে যাওয়া যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। হুয়ান পুওল গার্সিয়া (Juan Pujol Garcia)। বহু মানুষের মতে, মিত্রশক্তির এই ‘সুপারস্পাই’ আদতে বাস্তবের জেমস বন্ড। যদিও ইয়ন ফ্লেমিং তাঁর উপন্যাসের চরিত্রটিকে নির্মাণ করেছিলেন ভিন্ন এক ব্রিটিশ গোয়েন্দা পোপভের ওপর ভিত্তি করে। সে-যাই হোক না কেন, অ্যাডভেঞ্চার কিংবা দুঃসাহসিকতার দিক থেকে জেমস বন্ডের থেকে কোনো অংশেই কম যেতেন না ‘ডবল স্পাই’ হুয়ান গার্সিয়া। ডবল অর্থে, একই সঙ্গে একই সময়ে দুই দেশের হয়ে ‘গুপ্তচরগিরি’ করেছেন তিনি।
শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। অকুস্থল স্পেন। ১৯১২ সালে বার্সেলোনায় জন্ম হুয়ানের। পড়াশোনা শেষ করে তিনি কাজ নেন একটি ছোট্ট হার্ডওয়্যার স্টোরে। তাছাড়া ছিল পারিবারিক খামার। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর মাসমাইনের চাকরি ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসাতেই ফিরে আসেন তিনি। আয় মন্দ ছিল না। স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মাকে নিয়ে ভরা সংসার। সুখে দিন কাটছিল দিব্যি। তবে ১৯৩৬ সালে স্পেনে বেজে ওঠে গৃহযুদ্ধের দামামা। আকস্মিক ধ্বসে পড়ে গোটা দেশের অর্থব্যবস্থা।
লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে তিনিও সরব হয়েছিলেন শাসক গোষ্ঠী, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যোগ দিয়েছিলেন মিছিলে, অবস্থানে। ফলস্বরূপ কারারুদ্ধ হতে হয় হুয়ানকে। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর বেশ খানিকটা জমিও। বছর খানেক পর জেল ছাড়া পেলেও, একনায়কতন্ত্র এবং কমিউনিজমের ওপর তীব্র ঘৃণার জন্ম হয় তাঁর মনে। ততদিনে ইউরোপ-জুড়ে প্রস্তুতি চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। নাৎসি জার্মানির অধিগ্রহণ করে চলেছে একের পর এক দেশ। অন্যদিকে স্প্যানিশ সরকারও সমর্থন করছে হিটলারের এই মতবাদ এবং দর্শনকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই দেশ ছাড়েন হুয়ান। বুঝেছিলেন, স্পেনের স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গেলে জার্মানির পতন ঘটাতে হবে অনিবার্যভাবে। এমন একটা চিন্তাভাবনা থেকেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন হুয়ান। দেশ, পরিবার, ব্যবসা— সবকিছু ছেড়ে পাড়ি দেন ব্রিটেনে।
তবে ব্রিটেনে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে হয় তাঁকে। প্রথমেই তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, শারীরিকভাবে তিনি দুর্বল। কাজেই যুদ্ধ লড়ার মতো অবস্থায় নেই তিনি। এদিকে কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতাও নেই গুপ্তচর বা গোয়েন্দা হিসাবে কাজ করার মতো। ফলে, এক-কথায় সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা বিভাগ— কোথাওই জায়গা হবে না তাঁর।
আর পাঁচজন হলে হয়তো এমআই-৫ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ফিরে যেতেন নিজের জীবনে। তবে হার মানেননি হুয়ান। বরং, একক উদ্যোগেই তিনি নেমে পড়েন বিশ্বযুদ্ধে। এরপর হিটলারর সমর্থক সেজে তিনি সোজা পাড়ি দেন মাদ্রিদের নাৎসি শিবিরে। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের কাছে আবেদন করেন, জার্মানির হয়ে গুপ্তচরের কাজ করতে চাওয়ার জন্য। আগে থেকেই তৈরি করে ফেলেন ভুয়ো ভিজা। ফলে কাজ পেতে অসুবিধা হয়নি খুব একটা। এরপর প্রশিক্ষণ চলে বেশ কিছুদিনের। তারপরই আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান ইনটেলিজেন্সের সদস্য হয়ে যান তিনি।
প্রাথমিকভাবে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল লন্ডনে। সেখানে গিয়ে সেখানকার গোপন তথ্য সরবরাহ করার জন্য। তবে লন্ডনে যাওয়া তো দূরের কথা। স্পেনের প্রান্তিক অঞ্চলে বসেই নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন গার্সিয়া। কাজ বলতে ভুয়ো তথ্য সংগ্রহ। হ্যাঁ, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ‘ইনফর্মেশন ওয়্যার’ কথাটির সঙ্গে সকলেই পরিচিত আমরা। তবে আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে, এই পথেই হেঁটেছিলেন গার্সিয়া। ব্রিটিশ সেনাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য সরবরাহ করেই বার বার নাৎসিদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতেন তিনি। অবশ্য সবসময় যে এভাবেই সাফল্য মিলত তা নয়। কখনও কখনও আবার ব্রিটিশ সংবাদপত্র ঘেঁটে দু-একটা সত্যিকারের খবরও নাৎসি শিবিরে পাঠাতেন তিনি।
যদিও খুব বেশিদিন চাপা থাকেনি তাঁর এই কার্যকলাপ। জার্মানদের আগেই ব্রিটিশ গুপ্তচরদের কাছে পৌঁছে যায় গার্সিয়ার খবর। তারপর খোদ এমআই৫ থেকে তাঁর আমন্ত্রণ আসে গুপ্তচর হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য। ব্রিটেনে এসে ফের হিটলারকে ভুয়ো চিঠি লেখেন তিনি। জানান, নাৎসি বাহিনীর জন্য লন্ডনের বুকে ২৭ জন গোয়েন্দার আস্ত একটি দল তৈরি করেছেন তিনি। বলাই বাহুল্য, গার্সিয়াকে ততদিনে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল জার্মান শিবির। ফলে, তাদের থেকে গোপন তথ্য আদায় করা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না তাঁর কাছে।
নরম্যান্ডির যুদ্ধে এই অন্ধবিশ্বাসের মূল্য দিতে হয় জার্মানদের। সেবার ফ্রান্সের এই যুদ্ধে আচমকাই নাৎসিদের ওপর হামলা করে বসেছিল মিত্রপক্ষের বাহিনী। অন্যদিকে এধরনের কোনো তথ্যই ছিল না জার্মান শিবিরে। বরং, গার্সিয়াই তাদের আশ্বাস দিয়েছিল, নরম্যান্ডি আক্রমণের কোনো সম্ভাবনাই নেই মিত্রপক্ষের।
এরপর আর বেশিদিন যুদ্ধ চলেনি। বছর খানেকের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করে জার্মান বাহিনী। তবে তার নেপথ্যে বড়ো অবদান ছিল এই স্প্যানিশ ডবল এজেন্টের— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। অথচ, জয়ের রূপকার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে যে চোখে চোখে রাখবে মিত্রপক্ষ, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন গার্সিয়া। ফলে, আরও কঠিনতর পথ বেছে নেন তিনি। ইউরোপ ছেড়ে আশ্রয় নেন ভেনেজুয়েলায়। তবে সেখানেও তৈরি হয় প্রাণহানির আশঙ্কা। কারণ, বিশ্বযুদ্ধের পর বহু নাৎসিদেরই আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল লাতিন আমেরিকা। তবে উপায়?
এরপর ভেনেজুয়েলা থেকে নিজেই এমআই৫-এর দপ্তরে যোগাযোগ করেন গার্সিয়া। ঘোষণা করে দিতে বলেন ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের হয়ে করা কোনো কাজের সম্পর্কেই মুখ খুলবেন না তিনি। তেমনটাই হয়েছিল শেষমেশ। খাতায় কলমে ১৯৪৮ সালে প্রয়াত হন গার্সিয়া। যদিও এরপর পরিচয় বদলে তিনি বেঁচে ছিলেন আরও ৪০ বছর। ভেনেজুয়েলায় সামান্য বইয়ের দোকান চালাতেন তিনি। এমনকি শেষ বয়সে, ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ সংসদদের উদ্যোগে ফিরেছিলেন লন্ডনে। লন্ডনেই ১৯৮৮ সালে প্রয়াত হন বিশ্বযুদ্ধের এই দুঁদে গুপ্তচর। তবে চার দশক পেরিয়ে গেলেও, আজ দিব্যি বেঁচে রয়েছে তাঁর কিংবদন্তি। গুপ্তচরবৃত্তি কিংবা স্পাই-এর প্রসঙ্গ উঠলে আজও ব্রিটিশ মুলুকে উচ্চারিত হয় হুয়ান গার্সিয়ার নাম…
Powered by Froala Editor