তখনও অবধি ভারতের কিছু প্রান্তিক মানুষ ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ‘সভ্য’ মানুষদের মধ্যে তেমন অসন্তোষ তখনও জন্মায়নি। ঠিক এই সময় রুখে দাঁড়ালেন ব্যারাকপুর সেনা ছাউনির সিপাহিরা। ভাবছেন, এ তো জানা গল্প! ১৮৫৭ সালে মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে শুরু সিপাহি বিদ্রোহের। না, এই বিদ্রোহ তার চেয়ে প্রাচীন। সিপাহী বিদ্রোহের ৩৩ বছর আগে ১৮২৪ সালে ব্যারাকপুর ছাউনিতেই ঘটে গিয়েছিল আরেকটি উত্থান। ক্রমশ কালের নিয়মে সেই কাহিনি হারিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। হারিয়ে গিয়েছে আন্দোলনের নেতা বিন্দি তিওয়ারির নামও।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন বার্মা দখলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তবে যুদ্ধে যেতে গেলে তো ভারতীয় সেনাদের ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে বার্মা আক্রমণের সহজ রাস্তা সমুদ্রপথে আক্রমণ করা। তখনই বেঁকে বসেছিলেন ব্যারাকপুর সেনা ছাউনির ভারতীয় সিপাহিরা। কালাপানি পেরিয়ে যুদ্ধে যাবেন না তাঁরা। হিন্দুদের কাছে, বিশেষত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে সমুদ্র পেরনোর চেয়ে গর্হিত অপরাধ আর কিছু হয় না। অবশ্য বিকল্প একটি ব্যবস্থা ঠিক হল খুব তাড়াতাড়ি। ঠিক হল, সরকপথেই ব্রহ্মদেশ সীমান্তে পৌঁছানো যাবে। গরুর গাড়িতে যুদ্ধের সরঞ্জাম চাপিয়ে তাই চট্টগ্রাম সীমান্তের দিকে যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া হল।
তবে এর পরেও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হল না। কারণ কোম্পানির তরফ থেকে বলা হল, কেবলমাত্র গোরা সৈনিকদের যাতায়াতের খরচই বহন করবে কোম্পানি। ভারতীয় সৈন্যদের নিজেদের খরচে গরুর গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে। এমনিতেই সিপাহিদের মাইনে খুব বেশি নয়। তার মধ্যে উর্দি থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক নানা খরচ করতে হত নিজেদেরই। এদিকে যুদ্ধের বাজারে গরুর গাড়ির ভাড়াও বেড়ে গিয়েছে অনেক। গোরা সৈন্যরা আগেই গাড়ি ভাড়া করে জিনিসপত্র বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। ফলে গাড়ির চাহিদা বেড়ে গিয়েছে হঠাৎই। এই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু রেজিমেন্টের সেনারা কোম্পানির নির্দেশ মেনে নিলেও ৪৭ নম্বর রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করল।
বিন্দি তিওয়ারি নামের এক সিপাহির নেতৃত্বে ৪৭ নম্বর রেজিমেন্ট জোট বাঁধল। সরাসরি দাবিপত্র পেশ করা হল সেনাধ্যক্ষের কাছে। চট্টগ্রাম যাতায়াতের খরচ বহন করতে হবে কোম্পানিকেই। গাড়ির ব্যবস্থাও তাঁদেরই করে দিতে হবে। না হলে যুদ্ধের জন্য মাইনে দ্বিগুণ করতে হবে, যাতে সিপাহিদের অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে না হয়। সাধারন ‘নেটিভ’ সেনাদের এমন স্পর্ধা যে ব্রিটিশ সরকার ভালো চোখে দেখেনি, সে-কথা বলাই বাহুল্য। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হল, কোনো দাবিই মানা হবে না। এই পরিস্থিতিতে ৩০ অক্টোবর রাতে ইংরেজ সেনাদের ছাউনিতে বোমা ছোঁড়েন বিন্দি তিওয়ারি এবং তাঁর ভারতীয় সহকর্মীরা। রাতারাতি ছাউনি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন গোরা সৈনিকরা।
তবে ভারতীয় সেনাদের এই ঔদ্ধত্য মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরদিন সকালেই কমান্ডার ইন চিফ এডওয়ার্ড প্যাগেট এক বিরাট বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন ব্যারাকপুরে। দুই তরফের যুদ্ধে অনেকেই মারা গেলেন। যাঁরা ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন, তাঁদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হল। এমনকি মৃত্যুর পরেও বহুদিন দেহগুলি একইভাবে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে এই দৃশ্য বাকি সিপাহিদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। শোনা যায়, বিন্দি তিওয়ারিকে যে গাছে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তার নিচে কিছুদিন পর একটি হনুমান মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। তবে সিপাহিদের কাছে এই মন্দির ‘বিন্দি বাবার মন্দির’ নামেই পরিচিত ছিল। এর বহু বছর পর ব্যারাকপুরে সেনার চাকরি নিয়ে এসেছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে। মাঝে মাঝেই তিনি সেই হনুমান মন্দিরে গিয়ে বসে থাকতেন। বিন্দি বাবার কাছ থেকে হয়তো তখন থেকেই অনুপ্রেরণা খুঁজছিলেন তিনি। আর তাই সুযোগ পেয়ে আবারও এক বিরাট বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। ৩৩ বছর আগেই তার বীজ পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলেন বিন্দি তিওয়ারি।
তথ্যসূত্রঃ বারাকপুরের সেকাল-একাল, কানাইপদ রায় সম্পাদিত
মঙ্গল পাণ্ডেকে চেনেন? বিন্দি তিওয়ারিকে?, চান্দ্রেয়ী নিয়োগী, এইসময়
Powered by Froala Editor