যদিও কলকাতার গির্জাগুলির মধ্যে বয়সে এটি বেশ নবীন, তবু সারা গায়ে প্রাচীনত্বের চাপ। গ্রিসের ঐতিহ্যশালী প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালীঘাট ট্রাম ডিপোর পাশে। গির্জা নয়, আকারে প্রকারে যেন গ্রিক মন্দির বলেই মনে হয়। ‘এখানে ঈশ্বর বাস করেন’, নিউ টেস্টামেন্টের ভাবানুবাদে প্রবেশদ্বারের উপর লেখা। আর এখানেই থাকেন সিস্টার নেকটারিয়া পারিদিসি। এই মুহূর্তে কলকাতায় বসবাসকারী একমাত্র গ্রিক বংশোদ্ভুত তিনিই।
তবে কলকাতায় গ্রিক সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাসের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তেমনই পুরনো গির্জাটির ইতিহাসও। বর্তমান গির্জাটি তৈরি হয় ১৯২৫ সালে। তবে কলকাতায় গ্রিক মন্দিরের ইতিহাস খুঁজতে পৌঁছে যেতে হবে সেই সপ্তদশ শতকে। তখন ইউরোপের নানা দেশের বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এদেশে আসতে শুরু করেছেন। এইসময় দোভাষীর কাজ নিয়ে এলেন হেডি অ্যালেক্সিয়াস আরগিরি। তিনিই প্রথম গ্রিক, যিনি বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
কর্মসূত্রে তাঁকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হত। একদিন তেমনই রওনা হলেন মোচা ও জেন্ডা অঞ্চলের দিকে, জলপথে আলেকজান্দ্রা নামের জাহাজে চড়ে। কিন্তু হঠাৎ প্রবল তুফানে জাহাজ ডোবে ডোবে অবস্থা। আরগিরি তখন ঈশ্বরকে না ডেকে আর কী করবেন? প্রতিজ্ঞা করলেন, জীবিত ফিরে এলে স্বজাতিদের জন্য উপাসনালয় বানিয়ে দেবেন। ঝড় থামল। জীবিত ফিরে এলেন আরগিরি। ফিরে এসেই কলকাতায় কিছুটা জমি আর একটা দালান কিনে ফেললেন। তবে গির্জা তৈরির কাজ বেশিদূর এগোল না। তার আগেই মারা গেলেন তিনি।
তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার গ্রিক সম্প্রদায় ও কিছু স্থানীয় ব্যক্তি তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে আমড়াতলা স্ট্রিটে কলকাতার গ্রিক গির্জার ভিত্তি স্থাপন করা হয়। জমির দাম সহ গির্জাটি নির্মাণ করতে খরচ পড়ে ৩০ হাজার টাকা। যার অধিকাংশটাই দিয়েছিলেন আরগিরি পরিবার। আর বাকিটা ওঠে চাঁদা তুলে। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস নিজেই দিয়েছিলেন দুহাজার টাকা। আমড়াতলা স্ট্রিটের সেই পুরনো গির্জার পিছনের জমিতে রয়েছে কবরস্থান। সম্প্রতি ইষ্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডোরের কাজে যার উপর দিয়ে যথেষ্ট ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে। সেখানে নয় নয় করে ২০০টি কবর খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে সহজেই বোঝা যায়, এক সময় কলকাতায় গ্রিক জনজাতির বসবাসের পরিমাণ কেমন ছিল।
তবে শহরের ব্যস্ত অঞ্চলে গির্জার দুপাশে রাতারাতি গজিয়ে ওঠে উঁচু উঁচু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ফলে গির্জার নীরবতা হারিয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ ঠিক করে, গির্জা স্থানান্তর করা হবে। পুরনো জমি ও বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়। গির্জাটি স্থান পরিবর্তন করে আসে বর্তমান জায়গায়। তখন ১৯২৫ সাল। শহর কলকাতার সীমানা বলতে সার্কুলার রোড। ফলে নতুন জায়গাটি কলকাতার কোলাহলের বাইরেই বলা যায়।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত এটিই ছিল এশিয়ার একমাত্র গ্রিক গির্জা। তবে সম্প্রদায়ের মানুষরা ছাড়া বেশিরভাগই এই গির্জার খোঁজ রাখতেন না। প্রার্থনার জন্য জড়ো হওয়া মানুষের সংখ্যাও হত খুব কম। এর মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতার পর একে একে বহু গ্রিক দেশে ফিরে গেলেন। কেউ আবার চলে গেলেন লন্ডন বা অন্যত্র।
১৯৬০ সালের পর কলকাতায় স্থায়ী বসবাস করার জন্য আর একজন গ্রিকও থাকলেন না। ফলে চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে ছিল গির্জাটি। খাতায় কলমে প্রথম শ্রেণীর ঐতিহ্যশালী স্থাপত্য, কিন্তু যত্ন নিতে এগিয়ে আসেনি কোন প্রশাসন। অবশেষে ১৯৯১ সালে কলকাতার গ্রিক দূতাবাসের উদ্যোগে গির্জাটির সংস্কারের কাজ শুরু হয়।
তখনই কলকাতায় আসেন সিস্টার নেকটারিয়া পারদিসি। তারপর থেকে এখানেই থেকে গেছেন। গির্জার সঙ্গে সঙ্গে দেখাশুনা করেন একটি স্কুলের, দুটি অনাথ আশ্রমের। প্রথমদিন যে দশার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন গির্জাকে, সেই স্মৃতি আজও তাঁর কাছে অমলিন। দেয়ালে দেয়ালে কালো ময়লা, কাঠের আসবাব থেকে বইপত্র সব ঘুণে কেটে ফেলেছে। তারপর আস্তে আস্তে সারিয়ে তোলেন গির্জাকে। আর এই কাজে কলকাতার মানুষ এমনকি সরকারের কোনো সাহায্য পাননি। সেই অভিযোগ তাঁর থেকে গেছে। তবু তো কেটে গেল তিনটে দশক…
তথ্যসূত্র - রমাপদ চৌধুরী (সম্পা:), অচেনা এই কলকাতা, গ্রীক মন্দির, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত