সিওলের সমুদ্রের চেহারা সেদিন ভয়ঙ্কর। অদূরেই তৈরি হয়েছে শক্তিশালী নিম্নচাপ। একদিকে যেমন অবিরাম বৃষ্টিপাত চলছে, তেমনই ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে কয়েক ফুট উঁচু সমুদ্রের ঢেউ। হাওয়ার গতিবেগ প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ নট। অর্থাৎ, ৬৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি। এই প্রতিকূল আবহাওয়াকে হারিয়েই এগিয়ে চলেছেন তিনি। রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে। পরবর্তী প্রতিযোগীর থেকে তাঁর দূরত্ব ধরাছোঁয়ার বাইরে। পদক এক প্রকার নিশ্চিত। বাকি পথটুকু এই গতি ধরে রাখতে পারলে স্বর্ণপদকও পাকা করে পারেন তিনি। কিন্তু ফিনিশিং লাইনে আর পৌঁছানো হল না। তার আগেই ১৮০ ডিগ্রি বাঁক নিলেন তিনি।
অলিম্পিকের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে সম্বর্ধনা পাওয়া, মেডেলের দাবিদার হওয়া— যেকোনো অ্যাথলিটের জীবনে সবথেকে বড়ো স্বপ্ন। প্রাপ্তিও বটে। সেই সুযোগ হাতের মুঠোয় পেয়েও হাতছাড়া করেছিলেন তিনি। কানাডিয়ান সেইলর লরেন্স লেমিয়াক্স। সেদিন তাঁর দৌলতেই ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে ফুটে উঠেছিল মানবতার ফুল।
যে ঘটনা দিয়ে এই গল্পের শুরু, সেটা ১৯৮৮ সালের সিওল অলিম্পিকের। লরেন্সের বয়স তখন ৩২ বছর। সম্ভবত সেটাই তাঁর শেষ অলিম্পিক। বয়স বাড়ছে। চার বছর আগে লস অ্যাঞ্জেলিসে ত্রয়োদশ স্থান অধিকার করেছিলেন লরেন্স। অল্পের ব্যবধানেই আর জায়গা করে নেওয়া হয়নি প্রথম তিনে। সেই ব্যর্থতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল জেদ। চার বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের রুটিনে বেঁধে ফেলেছিলেন নিজেকে। আর তার ফলও পেয়েছিলেন হাতে-নাতে। ফিন সেইলিং-এ অনেক পরিণত লরেন্সকে লড়াই করতে দেখেছিল সিওল অলিম্পিক।
কিন্তু ফিনিশিং লাইনের ঠিক আগেই ঘটে গেল বিপত্তি। তৃতীয় প্রতিযোগীর থেকে কতটা এগিয়ে রয়েছেন, তা দেখতেই পিছনে ঘুরেছিলেন লরেন্স। তখনই নজরে আসে বিষয়টা। গভীর সমুদ্রে ভাসছে দুটি কমলা রঙের ক্যানোপি বোটের মাস্তুল। একটিকে ততক্ষণে গিলে নিয়েছে সমুদ্রের চোরাস্রোত। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার সেইলর। অন্যটিও ডুবে না গেলেও প্রকৃতির কাছে ধরাশায়ী। ঢেউয়ের আছাড়ে সমুদ্রে পড়ে গেছেন তার চালক। কিন্তু উদ্ধারকারী টিম?
আরও পড়ুন
বরানগরের অতনুর হাত ধরেই অলিম্পিকে পদকের স্বপ্ন দেখছে ভারত
আরও পড়ুন
১২৮ বছর পর অলিম্পিকে ফিরতে চলেছে ক্রিকেট
না, তাঁদের দেখা নেই। আসলে বিষয়টার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও অবগত নন তাঁরা। বৃষ্টির কারণে গোটা দৃশ্যটাই তাঁদের নজরের আড়ালে। কিন্তু এভাবে দুই অলিম্পিয়ানের প্রাণ তো যেতে পারে না! বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে নিজের নৌকার দিক পরিবর্তন করলেন লরেন্স। উথালপাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করেই পৌঁছে গেলেন তাঁদের কাছে।
আরও পড়ুন
দীর্ঘ দু-দশক পর অলিম্পিকের ইকোয়েস্ট্রিয়ান খেলায় প্রতিনিধিত্ব ভারতের
দুর্ঘটনার এই দৃশ্য লরেন্সের চোখে সেদিন না পড়লে প্রাণ যেত সিঙ্গাপুরের দুই সেইলর জোসেফ চ্যান এবং সিউ স’-এর। ‘মসিহা’ হয়েই সেদিন তাঁদের নিজের ক্যানোপিতে জায়গা করে দিয়েছিলেন লরেন্স। উদ্ধারকারী টিম না আসা পর্যন্ত মাঝসমুদ্রে ডিঙি নিয়ে ওভাবেই অপেক্ষা করে ছিলেন তিনি। তারপর পুনরায় প্রত্যাবর্তন রেসিং-এ। ততক্ষণে অবশ্য তাঁকে ফেলে এগিয়ে গেছে অনেকেই।
না, অলিম্পিকের মেডেল অধরাই থেকে যায় তাঁর। ২১তম প্রতিযোগী হিসাবে সেবার ফিনিশিং লাইনে পৌঁছেছিলেন লরেন্স। নিজের ক্লাসে হয়েছিলেন সপ্তম। পরের অলিম্পিকেও আর সুযোগ আসেনি। অলিম্পিকের ইতিহাসে এহেন দ্বিতীয় উদাহরণ খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। তবে পদক না জিতলেও এই কৃতিত্বের জন্য অলিম্পিকের ইতিহাসে অমর হয়েই থেকে গেছে লরেন্স লেমিয়াক্সের নাম। তাঁর এই মানবিক উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছিল সিওলের অলিম্পিক মঞ্চে। স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের জন্য তিনি অলিম্পিক চলাকালীনই পান ‘পেরি ডে কোবার্টিন’ পদক। তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি বিরল এই মেডেল পেয়েছেন অলিম্পিক চলাকালীন সময়ে।
আজ সত্তরের কোঠায় দাঁড়িয়েও অলিম্পিক পদকের ব্যাপারে এতটুকুও হতাশা নেই লরেন্সের। নেই বিরল কৃতিত্বের জন্য গর্ববোধও। বরং তিনি মনে করেন তাঁর জায়গায় যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেই এমন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কিন্তু সত্যিই এমন আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার পরিচয় আর ক’জনই বা দিতে পারেন?
Powered by Froala Editor