যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আর বালি। পায়ের তলায় তপ্ত বালি। সেইসঙ্গে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। ঊষ্ণতা ছাড়িয়ে গেছে পঞ্চাশের কোঠা। ফুরিয়ে গেছে জলও। এদিকে তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে গলা। সাহারার (Sahara) আদিগন্ত এই ধূ-ধূ প্রান্তরে কোনো জনমানবের দেখা নেই কোথাও। সেইসঙ্গে পদে পদে লুকিয়ে আছে বিপদ। বিষাক্ত স্যান্ড ভাইপার আর কাঁকড়াবিছের রাজত্ব সেখানে। কার থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে এতটুকু?
হঠাৎ করে এই বর্ণনা শুনলে 'চাঁদের পাহাড়'-এর শঙ্করের কথাই মনে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়ার পর সাহারার এই ভয়ঙ্কর প্রান্তরেই পথ হারিয়েছিল শঙ্কর। তবে এই গল্প শঙ্করের নয়। যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে তিনি খ্যাতনামা ইতালিয়ান অলিম্পিয়ান মাউরো প্রসপেরি (Mauro Prosperi)। সাহারা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন তিনি।
সেটা ১৯৯৪ সালের কথা। মাউরোর বয়স তখন ৩৯ বছর। প্রাক্তন পেন্টাথলন অলিম্পিয়ান এক বন্ধুর থেকেই সন্ধান পেয়েছিলেন বিশ্বের কঠিনতম ম্যারাথন প্রতিযোগিতার। 'ম্যারাথন দেস সেবলস' বা 'স্যান্ড ম্যারাথন'-খ্যাত এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়াই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর।
সাহারার এই বিপদসঙ্কুল প্রান্তরে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয় প্রতিযোগীদের। সেইসঙ্গেই নিজের কাঁধে বহন করতে হয় খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী। অবশ্য মাউরো তখনও পর্যন্ত খেলাধুলোর জগতে সক্রিয় থাকায় খুব একটা চ্যালেঞ্জিং ছিল না এই প্রতিযোগিতা। ত্রুটি ছিল না প্রস্তুতিতেও।
প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই নিজেকে চেনা ছন্দে মেলে ধরেছিলেন মাউরো। এমনকি ৪ দিনের শেষে চতুর্থ স্থান ধরে রেখেছিলেন তিনি। তবে তারপরেই ঘটে বিপত্তি। পঞ্চম দিনেই ভয়াবহ মরুঝড়ের শিকার হন মাউরো। হয়তো সেদিনই তীব্র ঝড়ে সলিলসমাধি হয়ে যেত তাঁর। কোনোক্রমে স্কার্ফে মুখ ঢেকে রক্ষা পান মাউরো। ঝড় থামলে বালির স্তূপের মধ্যে থেকে উদ্ধার করেন তাঁর সামগ্রী। তব প্রাণ বাঁচলেও পথ হারান তিনি মাউরো।
প্রাথমিকভাবে তাঁর মনে হয়েছিল অন্যান্য প্রতিযোগীরা এগিয়ে গেছেন তাঁর থেকে। জেতার নেশায় আরও গতি বাড়িয়ে এগিয়ে চলেন তিনি। প্রায় একদিন পর মাউরো বুঝতে পারেন, সাহারার এই ভুলভুলাইয়ার শিকার হয়েছেন তিনি। তখন দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। আরও দিন দুয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় সঞ্চিত জল ও খাদ্যের ভাণ্ডারও। তেষ্টা মেটাতে কখনও নিজের প্রস্রাব, কখনও বাদুড়ের রক্ত পান করেছেন তিনি। পেটের জ্বালা মিটিয়েছেন বিষাক্ত সাপ মেরেই।
অবশ্য এর মধ্যে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার ক্ষীণ সুযোগ এসেছিল একটা। ততদিনে তাঁর জন্য সার্চ অপারেশন শুরু করে দিয়েছে ম্যারাথন কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দুটি বিমান উড়ে যায় মাউরো মাথার ওপর দিয়ে। প্রথমবার একমাত্র ফ্লেয়ারটি আকাশে ছু্ঁড়েছিলেন তিনি। পরেরবারে জ্বালিয়েছিলেন নিজের স্লিপিং ব্যাগ-সহ সমস্ত সামগ্রী। বাঁচার মরিয়া চেষ্টা যাকে বলে। তবে লাভ হয়নি কিছুই। মরিচীকার কারণে উপর থেকে মাউরোকে সঠিকভাবে চিহ্নিতই করতে পারেননি উদ্ধারকর্মীরা। ধরে নেওয়া হয় মারা গেছেন মাউরো। কিন্তু আদতে শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তাঁর? সাহারার এই জাল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি?
ফিরে যাওয়া যাক সেই গল্পেই। পথ হারানোর প্রায় ১২ দিন পর মৃতপ্রায় মাউরোকে উদ্ধার করেন একদল স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের মেষপালক। তখন জ্বরাক্রান্ত তিনি। প্রায় দীর্ঘ দু'সপ্তাহের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সুস্থতার মুখ দেখেন প্রাক্তন অলিম্পিয়ান। তবে ওজন কমে যায় প্রায় ১৬ কেজি। শুশ্রূষার পাশাপাশি যাযাবর সম্প্রদায়ের সেই মানুষগুলিই মরক্কোয় পৌঁছে দেন মাউরোকে। দেখা গিয়েছিল, ফিনিশিং লাইনের থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছিলেন তিনি।
তবে এর পরেও থেমে থাকেননি তিনি। বরং, এই স্যান্ড ম্যারাথনই নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর। পরবর্তীতে আরও ৩ বার এই ম্যারাথন লড়েছেন মাউরো। জয় আসেনি ঠিকই তবে নজর কেড়েছিলেন গোটা বিশ্বের। তা-ই বা কম কী? মাউরোর এই হার না মানা জেদ যেন হুবহু মিলে যায় শঙ্করের সঙ্গেই...
Powered by Froala Editor