কর্মসূত্রে কিংবা পড়াশোনার জন্য, এক শহর থেকে অন্য শহরে পাড়ি দেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রীকেই সঙ্গে নেয় মানুষ। তবে আস্ত বাড়িকে যদি সমূলে উপড়ে নিয়ে যাওয়া হয় নতুন কোনো শহরে?
এমন কথা শুনলে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। তবে আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে এমনই এক আশ্চর্য দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন বোম্বাই-এর (Bombay) ‘কালা ঘোড়া’ জেলার বাসিন্দারা। ১৮৬৭ সালে জাহাজে করে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রকাণ্ড এক বহুতল খাঁচা। আয়তনে তা এতটাই বড়ো যে, অনায়াসেই তার মধ্যে ঢুকে যেতে পারে এই পৃথিবীর সমস্ত পাখি। তবে ঢালাই লোহার তৈরি এই প্রকাণ্ড খাঁচা আদতে পাখি নয়, বরং তৈরি হয়েছিল মানুষের জন্যই। এই খাঁচার গায়েই ধীরে ধীরে ইট, পাথর, মার্বেল বসিয়ে গড়ে তোলা হয় ভারতের প্রথম পাঁচ তারা হোটেল।
‘ওয়াটসন’স হোটেল’ (Watson's Hotel)। ভারতের প্রাচীনতম ঢালাই লোহার তৈরি ভবন এটিই। সাধারণত, বর্তমানে বাড়ির মূল কাঠামো তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় স্টিলের রড এবং কংক্রিট। অবশ্য আজ থেকে দু-আড়াইশো বছর আগে এই প্রযুক্তি ছিল না মানুষের হাতে। সে-যুগে সবচেয়ে মজবুত ও টেকসই স্থাপত্য কাঠামো হিসাবে ধরে নেওয়া হত ঢালাই লোহার খাঁচাকেই। গোটা বিশ্বে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ‘কাস্ট আয়রন’ বা ঢালাই লোহের বাড়ি বেঁচে রয়েছে বর্তমানে। যার মধ্যে অন্যতম ‘ওয়াটসন’স হোটেল’।
নাম থেকেই আন্দাজ পাওয়া যায় এই হোটেল নির্মাণের নেপথ্যে রয়েছেন ওয়াটসন নামের এক ব্যক্তি। জন ওয়াটসন। না, শার্লক হোমসের সেই প্রিয় চিকিৎসক বন্ধু নন ইনি। বরং আমাদের গল্পের জন ছিলেন এক ব্রিটিশ কাপড় ব্যবসায়ী। মূলত বোম্বাইতেই ব্যবসা ছিল তাঁর। ভারতের বাজারে কলে বোনা কাপড় বিক্রি করে লাভও করেছিলেন বিস্তর। ১৮৬৪ সালে দক্ষিণ বোম্বাইতে টেলারিং-এর অফিস এবং শোরুম তৈরির জন্য বেশ খানিকটা জমি কিনে ফেলেন তিনি। অবশ্য পরে সিদ্ধান্ত পাল্টান ওয়াটসন। ঠিক করেন, শোরুমের বদলে তৈরি করবেন বিলাসবহুল একটি হোটেল।
ওয়াটসনের এই পরিকল্পনাকে মন্দ বলা চলে না একেবারেই। কারণ, যে-সময়ের কথা হচ্ছে, তখন ভারতের বুকে বিলাসবহুল হোটেলের কথা ভাবাটাই দুঃস্বপ্ন। এদিকে এ-দেশে তখন মাঝে মধ্যেই পাড়ি দিতে হয় ব্রিটিশ সাহেবদের। তাঁরা তো আর ভারতীয়দের ভাঙা-চোরা কুঠুরিতে থাকতে পারেন না। মোটা টাকা খরচ করে থাকতে চান বিলাসিতার সঙ্গে। ফলে অঙ্কটা যে দুয়ে দুয়ে চার হতে পারে— স্পষ্টতই তার আন্দাজ পেয়েছিলেন ওয়াটসন। কিন্তু কীভাবে কম খরচে তৈরি করা সম্ভব এই প্রকাণ্ড ভবন?
এই সমস্যা সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত পুনর্ব্যবহারের পথে হেঁটেছিলেন ওয়াটসন। হ্যাঁ, বাতিল লোহার সরঞ্জাম নতুন করে ঢালাই করেই তৈরি করা হয়েছিল এই হোটেলের প্রকাণ্ড খাঁচা। ব্রিটেনেই তৈরি করা হয় সেই খাঁচা। তারপর বিভিন্ন অংশে ভেঙে জাহাজে করে সেই খাঁচা পাঠানো করে ভারতে। তবে শুধু মূল কাঠামোটিই নয়, সঙ্গে দেওয়াল তৈরির জন্য ব্যবহৃত ইট এবং সিমেন্টও আমদানি করা হয়েছিল ব্রিটেন থেকেই। টাইলস এসেছিল স্ট্যাফোর্ডশায়ার শহর থেকে। অন্যদিকে থামের ওপর বসানো রেডস্টোন আনা হয়েছিল কামবারল্যান্ড থেকে। সবমিলিয়ে গোটা ভবনটিই তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে আমদানি করা সরঞ্জাম দিয়ে।
১৮৬৭-৬৯— টানা দু’বছরের সময় লাগে ভারতের বুকে এই প্রকাণ্ড ভবনটির বিভিন্ন অংশ একত্রিত করতে। তারপর আরও দু’বছর সময় লেগেছিল তার ভেতরের অংশ সাজাতে। ১৮৬৯ সালে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঢালাই-লোহা স্থাপত্য নিদর্শন হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় ব্রিটিশ সিভিল ইঞ্জিয়ার রোল্যান্ড মেসনের নকশাকৃত এই ভবনটি। উল্লেখ্য, এই হোটেল ছিল ঢালাই লোহার তৈরি বিশ্বের প্রথম বহুতল।
১৮৭১ সালে এই হোটেলটির দরজা খুলে যায় পর্যটকদের জন্য। কী ছিল না সেখানে? পাশ্চাত্য নান্দনিকতা তো ছিলই, সঙ্গে স্টিম চালিত এলিভেটর বা লিফট, বিলাসবহুল শয়নকক্ষ, লবি, সংযুক্ত বাথরুম, রেস্তোরাঁ, গ্লাস স্কাইলাইট, পুল খেলার বন্দোবস্ত— সবই ছিল ওয়াটসন’স হোটেলে। ১৮৭৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ আসার পর, এখানেই সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল সিলিং ফ্যান। মার্ক টোয়েন থেকে শুরু করে লুমিয়ের ব্রাদার্স— সে-সময় বিশ্বের বিখ্যাত কিংবদন্তিরা এসে রাত্রিবাস করতেন এই হোটেলে। এমনকি এখানে স্ক্রিনিং হয়েছিল লুমিয়ের ব্রাদার্সের তৈরি ছবি। সেটাই ছিল ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র-দর্শন।
অবশ্য কেবলমাত্র এই হোটেলের পরিষেবা নিতে পারতেন শ্বেতাঙ্গ সাহেবরাই। সেখানে নিষিদ্ধ ছিল ভারতীয়দের প্রবেশ। পরবর্তীতে ওয়াটসনের এই সিদ্ধান্তই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর হোটেলের কাছে। কথিত আছে, এই হোটেলে প্রবেশ করতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় উদ্যোগপতি জামশেদজি টাটাকে। এই ঘটনার পরই ‘ওয়াটসন’স হোটেল’-এর নিকটেই তিনি গড়ে তোলেন ‘তাজ’-কে। বলাই বাহুল্য, ‘ওয়াটসন’স হোটেল’-এর কোনো অংশেই কম ছিল না ভারতীয় উদ্যোগপতির তৈরি এই হোটেল। পাশাপাশি তাজের কর্মচারীডের পরিষেবা এবং তুলনামূলক কম ভাড়াও সে-যুগে আকর্ষণ করেছিল বিদেশি পর্যটকদের। তাজের কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা কমতে থাকে ‘ওয়াটসন’স হোটেল’-এর।
১৯৬০-এর দশকে মালিকানা বদল হয় এই হোটেলর। চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায় রাত্রিবাসের পরিষেবা। প্লাই উডের মাধ্যমে বড়ো ঘরগুলি ভাগ করে দেওয়া হয় ছোটো ছোটো কিউবিকলে। সেগুলি ব্যবহৃত হতে শুরু করে অফিস এবং মানুষের স্থায়ী বাসস্থান হিসাবে। আজও সেখানে দিব্যি সচল রয়েছে বহু অফিস।
২০০৫ সালে এই ভবনটিকে ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভবন হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ‘ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড’। এমনকি ভারতেরও ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকায় নাম রয়েছে ওয়াটসনের হোটেলের। তবে তা-সত্ত্বেও পরিচর্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমে ধুঁকছে এই স্থাপত্য। ২০০৫ সালে খসে পড়েছিল আস্ত একটি লোহার ব্যালকনি। মারা গিয়েছিলেন এক ব্যক্তি, জখম হন আরও ৬ জন। ২০২০ সালে প্রাণহানি না হলেও, ঘটেছিল আরও একটি দুর্ঘটনা। তবে এতকিছুর পরেও প্রাচীন স্থাপত্যটিকে সংরক্ষণের জন্য কোনোরকম তাপ-উত্তাপ নেই স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে…
Powered by Froala Editor