৩ হাজার বছরের প্রাচীন ‘স্কাই-ডিস্ক’ ও মহাকাশচর্চার ইতিহাস

মাত্র দুই দশক আগের ঘটনা। গত শতাব্দীর শেষ বছরে জার্মানির বিস্তীর্ন অঞ্চলে গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন দুই ব্যক্তি। নানা জায়গায় মাটি খুঁড়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে থাকেন। এর মধ্যেই হঠাৎ খবর পৌঁছে যায় জার্মান পুলিশ বিভাগের কাছে। এভাবে অনুসন্ধান চালানোর কোনো অনুমতিই নেই তাঁদের। হেনরি ওয়েস্টফেল ও মারিও রেনার নামের সেই দুই ভাগ্যান্বেষী পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি তাঁদের সমস্ত সংগ্রহ বিক্রি করে পালিয়ে যান বিদেশে। পুলিশ দুই চোরাকারবারির সন্ধান পায় না ঠিকই। কিন্তু তদন্তে নেমে এক অদ্ভুত জিনিসের কথা জানতে পারেন। বিদেশে চলে যাওয়ার ঠিক সপ্তাহখানেক আগে তাঁরা হাল্লে শহরের কাছে নেব্রা অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। আর সেখানেই নাকি এক অদ্ভুত সিল পেয়েছিলেন, যাতে সোনার পাত বসিয়ে আঁকা ছিল সূর্য-চাঁদ সহ নানা ছবি।

এভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছিল নেব্রার বিখ্যাত স্কাই-ডিস্ক। হেনরি ও মারিওর বিক্রি করা সমস্ত জিনিসের অনুসন্ধান করতে করতে সেই ডিস্ক এসে পৌঁছায় জার্মান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের হাতে। জিনিসটি যে শুধু ঐতিহাসিক, তাই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীনকালের মানুষের মহাকাশবিজ্ঞানের চর্চাও। আনুমানিক ৩ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে ব্রোঞ্জ যুগে তৈরি হয়েছিল এই সিল। তার ব্রোঞ্জের পাতটির উপরে নীলচে সবুজ আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। তবে সোনার পাত খোদাই করে আঁকা চাঁদ, সূর্য এবং তারাগুলি আজও একইরকম উজ্জ্বল। এর মধ্যে বিখ্যাত প্লিয়েডস নক্ষত্রপুঞ্জটিকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। সেই যুগের মানুষ আকাশকে যেভাবে দেখেছে, তাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে এই সিলের মধ্যে।

তবে নেব্রার স্কাই-ডিস্কের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকই। আজও অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এই সিলটি আসল নয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি করা। তবে সেই সব জল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে ২০১৩ সালে সিলটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল চাঁদ ও সূর্যের সহাবস্থান। মানুষ খালি চোখে যা দেখেছে, তাই যদি হুবহু ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করত, তাহলে এমনটা সম্ভব হত না। কিন্তু ৩ হাজার বছর আগেও মানুষ নিজের কল্পনাকে মিশিয়ে নিতে শিখেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সিল একবারে তৈরি হয়নি। এর শুরুটা হয়েছিল অস্ট্রিয়া অঞ্চলে। কারণ ব্রোঞ্জের নমুনাটি সেখান থেকেই সংগৃহীত বলে মনে করা হয়। আবার সোনার পাতগুলির কিছু কিছু অংশ সুদূর ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা। অতএব যাঁরা এই সিল সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁরা অস্ট্রিয়া থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য জার্মানির ন্যাশনাল মিউজিয়ামেই রেখে দেওয়া হয়েছে সিলটি। এতদিন পর্যন্ত দেশের বাইরে কোথাও তার প্রদর্শনীও হয়নি। তবে এবার ইংল্যান্ডের বুকেই প্রদর্শিত হতে চলেছে নেব্রার স্কাই-ডিস্ক। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই আয়োজন করা হয়েছে ‘স্টোনহেঞ্জ প্রদর্শনী’-র। ইংল্যান্ডের অন্তত আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্য এই স্টোনহেঞ্জ তৈরির উদ্দেশ্য আজও অজানা। তবে তার গঠনের সঙ্গে সূর্যের গতিবিধির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলে প্রাচীন মানুষের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার এক অনবদ্য উদাহরণ এই স্টোনহেঞ্জ। আর সেই স্টোনহেঞ্জকে ঘিরে প্রদর্শনীরর সঙ্গেই প্রাচীন মানুষের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আরও নানা উপকরণ সামনে আনা হবে। তার মধ্যেই রয়েছে এই স্কাই-ডিস্ক। নেব্রার স্কাই-ডিস্ককে ঘিরে বিতর্ক আজও রয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে জার্মানির বাইরে প্রথম প্রদর্শনীকে ঘিরে উন্মাদনাও।

আরও পড়ুন
শরণার্থী জীবন ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে তুলে ধরেই নোবেলজয় তাঞ্জানিয়ান কথাসাহিত্যিকের

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ, ফিরল টাটাদের হাতেই

Latest News See More