ইংল্যান্ড। ইউরোপের এই দ্বীপরাষ্ট্রের হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল শিল্পবিপ্লবের। লিভারপুল, লিডস, ম্যাঞ্চেস্টার-জুড়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল বিশাল কারখানা। বদলে গিয়েছিল সভ্যতার গতিপথ। ঘোড়ায় টানা গাড়ির বদলে মোটরগাড়ির প্রচলন থেকে শুরু করে স্টিমার, কয়লা চালিত রেল ইঞ্জিন— সবকিছুরই সূত্রপাত হয়েছিল ব্রিটেনে। তবে এই শিল্পবিপ্লবের দেশেই যদি দেখা মেলে দাঁড়-টানা নৌকার (Rowboat)?
হ্যাঁ, এমন দৃশ্যের সাক্ষী হলে একটু অবাক হতে হবে বইকি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের (England) বুক দিয়ে বয়ে গেছে ব্লাইথ নদী (Blyth River)। তার একপ্রান্তে সাউথওল্ড শহর, অন্যদিকে ওয়ালবারসউইক। আর এই দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম আজও ছোট্ট কাঠের নৌকা। মোটর নয়, বরং দাঁড় টেনেই এই নৌকা নদী পারাপার করান মাঝিরা। বলতে গেলে, ওয়ালবারসউইক-সাউথওল্ডের এই ফেরি পরিষেবা আজও আটকে রয়েছে সেই প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগেই। নৌকার মতোই বিবর্তিত হয়নি এই ফেরিঘাটের রূপও। পুরনো, জীর্ণ কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েই উঠতে হয় নৌকায়।
অবশ্য প্রাক-শিল্পবিপ্লব বললেও ভুল হবে খানিক। আসলে এই ফেরি পরিষেবার ইতিহাস আরও প্রাচীন। আজ থেকে আনুমানিক ৮০০ বছর আগে, সম্ভবত ১২৩৬ সালে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছিল এই দুই শহরের মধ্যে। অবশ্য তখন ব্লাইথ নদীর গতিপথ আজকের থেকে খানিকটা ভিন্ন ছিল। ডানউইচ উপকূল থেকে তিন মাইল দূর দিয়ে প্রবাহিত হত তৎকালীন ব্লাইথ। আর এই নদী ধরে আরও দক্ষিণে গেলেই সোজা পৌঁছানো সম্ভব হত সমুদ্রের মোহনায়।
সে-যুগে স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ততটাও উন্নত না হওয়ায়, শ্রমিকদের মোহনা সংলগ্ন বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হত ব্লাইথের স্রোত। চালু করা হয়েছিল নৌকা পরিষেবা। ধীরে ধীরে শুধু মোহনাই নয়, বরং নদী পারাপারের জন্যও চালু হয় ফেরি। এর বহু পরে নদীর বিপরীত প্রান্তে গড়ে ওঠে ওয়ালবারসউইক জনপদ।
ত্রয়োদশ শতকের বিভিন্ন ব্রিটিশ গির্জায় পাওয়া নথি থেকে জানা যায়, সে-সময় এক পেনি অর্থে দু’বার নদী পারাপার করতে পারতেন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এবং তাঁর ঘোড়া। পাশাপাশি আরেকটু বেশি অর্থ খরচ করলে, পরিবর্তে কয়েক ঘণ্টার জন্য ভাড়া পাওয়া যেত নৌকা। মাছ ধরতে আগ্রহী বহু বাবুই নৌকা ভাড়া নিয়ে ছিপ ফেলতেন মাঝনদীতে।
এর পর বহু জল পেরিয়ে গেছে ব্লাইথের বুক দিয়ে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হওয়ার পর, বড়ো ধাক্কা খায় এই ফেরি পরিষেবা। অনেকেই দাঁড় টানার পেশা ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন কল-কারখানায়। কেউ আবার কিনেছিলেন স্টিমার, যন্ত্র চালিত বোট। পাশাপাশি মাছ ধরার জন্য ট্রলার ও অন্যান্য প্রযুক্তি চলে আসায়, নৌকার ব্যবহার কমে গিয়েছিল এক ধাক্কায়। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারই কেবলমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এই ঐতিহ্যকে। মূলত হতদরিদ্র শ্রমিকরা, যাঁরা স্টিমারের টিকিটের জন্য বেশি মূল্য দিতে অক্ষম, তাঁরা যাত্রী হতেন এই নৌকাযাত্রার।
মজার বিষয় হল, গুটিকয়েক যে মাঝি-পরিবারের জন্য অস্তিত্ব টিকে গিয়েছিল এই ফেরি পরিষেবার, আজও তাদের উত্তরসূরিরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন এই ধারাকে। এমনকি আজ ব্লাইথের এই ফেরিঘাটে গেলে দেখা যাবে পুরুষদের পাশাপাশি নৌকার হাল টানছেন মহিলারাও। নদী পারাপারের খরচ আজও স্টিমারের থেকে কম। শুধু পরিবর্তন বলতে, ১২ জনের ছোট্ট এই নৌকায় এখন ঘোড়া পারাপার করে না। বরং, অনেকে বাইক বা সাইকেল নিয়ে হাজিরা দেন ফেরিতে। কেউ আবার সঙ্গে রাখেন পোষ্য সারমেয়কে। অবশ্য দৈনন্দিনের যাত্রীদের তুলনায় দেশ-বিদেশের পর্যটকরাই বেশি ব্যবহার করেন এই ফেরি পরিষেবা। বিশেষত, ২০০১ সালে ইংল্যান্ডের এই প্রাচীনতম জীবিত ম্যানুয়াল ফেরির স্বীকৃতি পায় এই নৌ-পরিষেবা। প্রকাশিত হয় বিশেষ গবেষণাপত্রও। তারপর থেকেই ব্রিটেনে রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওয়ালবারসউইক-সাউথওল্ডের এই নৌপথ।
একটা সময় কলকাতা তথা বাংলার বুকেও রাজত্ব ছিল এধরনের অসংখ্য নৌপথের। নদ-নদী, খাল-বিল দিয়ে বয়ে চলত বাণিজ্যতরী, যাত্রীবাহী নৌকার বহর। অথচ, তার অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়েছে আজ। পুরনায় এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হলে, বাংলাও হয়ে উঠতে পারে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু, বদলে যেতে পারে অর্থনীতি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ইংল্যান্ডের এই প্রাচীনতম নৌ-পরিষেবা…
Powered by Froala Editor