নির্বাচনের প্রথম পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। অন্যদিকে প্রতি রাজনৈতিক দলেরই প্রচার চলছে পুরোদমে। আর এমনই এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছোতে ভরসা হয়ে উঠছে গান। কখনো প্যারোডি আবার কখনো একেবারে নতুন ঝকঝকে সুর। এবার এই ডামাডোলের মধ্যেই আবার নতুন করে ভাষা পেল গণসঙ্গীত।
স্বাধীনতারও আগে চল্লিশ পঞ্চাশের দশক থেকেই বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে বার বার উঠে এসেছে গণসঙ্গীত। সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র কিংবা রুমা গুহঠাকুরতা— সকলেই কণ্ঠেই বার বার আন্দোলিত হয়েছে গণসঙ্গীতের সুর। উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়ার কথা। এবার সেই ভার কাঁধে তুলে নিলেন বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা। নাট্যকার জয়রাজ ভট্টাচার্য কিংবা কবি মন্দাক্রান্তা সেনের কলমে প্রাণ পেল গণসঙ্গীত। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘আমি তুমি আমি আমরা সবাই’ কিংবা ‘হোক মহল্লা’-র মতো গান বাম-ইতিহাসের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এইসব গানের প্রভাব কি দীর্ঘস্থায়ী হবে?
“সত্তর দশকের যেসব গান বাঁধা হয়েছিল সেগুলোতে আমরা দেখিনি। তবে এখনও সেসব গান শুনলে সমানভাবে গায়ে কাঁটা দেয়। ‘উই শ্যাল ওভার কাম’ কতদিন আগে বাঁধা হয়েছিল, আজও সারা বিশ্বে গাওয়া হয় গানটা। এই গানগুলো চিরজয়ী, কালজয়ী। এখন যে গানগুলো মানুষকে অ্যাপ্রোচ করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে, কর্তব্যবোধ জাগানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছ— এগুলো কতদিন টিকবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। তবে বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই গানগুলো অত্যন্ত প্রয়োজন”, জানালেন কবি মন্দাক্রান্তা সেন।
অন্যদিকে জয়রাজ ভট্টাচার্যের লেখা ‘হোক মহল্লা’-য় কণ্ঠ দিয়েছেন অর্ক মুখার্জি। গণসঙ্গীত তো বটেই, সেইসঙ্গে সেই গানে মিশে গেছে রকসঙ্গীতের আবহও। একদিকে যেমন বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেই গান, পাশাপাশি কোথাও উঠেছে বিতর্ক। কিন্তু গণসঙ্গীত আর রক— দুটো ধারা সত্যিই কি আলাদা? উত্তর দিলেন জয়রাজ ভট্টাভার্য, “গণসঙ্গীতের সঙ্গে রকসঙ্গীতকে মেলাব তেমন ভাবনা-চিন্তা করে যে গানটা বানিয়েছিলাম, সেটা একাবারেই নয়। রকসঙ্গীতের ইতিহাস দেখলে বুঝবেন, একটা বিদ্রোহী গণচেতনা থেকেই রকসঙ্গীতের জন্ম। গোটা বিষয়টাকে একটা ইউরোসেন্ট্রিক চেতনা থেকে যদি দেখা যায়, তবে তার রুট ফিরে ফিরে গিয়ে সেই গসপেলে গিয়েই পৌঁছবে। স্তালিন বলেছিলেন, বামপন্থীরা যখন কোনো কাজ করবে তখন তার মধ্যে আন্তর্জাতিক খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলবে। আর তার ফর্ম একদম আঞ্চলিক হবে। এখন রকসঙ্গীত এখানকার ধারা নয়। কিন্তু বিগত কুড়ি-পঁচিশ বছরে সঙ্গীতের যে আবহ তৈরি হয়ে আছে, সেখানে রকসঙ্গীতকে বিজাতীয় বলা যায় না। তার একটা আলাদা অ্যাপিল রয়েছে। কাজেই যে ধারাটা সবথেকে বেশি মানুষকে পেনিট্রেট করে সেটাতেই আমরা থাকতে চেয়েছি।”
তবে গত দেড়দশক ধরে প্রায় অস্তিত্ব হারাতে বসেছিল গণসঙ্গীত। এক ঐতিহ্যবাহী সমবেত কণ্ঠে প্রতিবাদের ধারা যেন অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বাংলা থেকে। প্রশ্ন থেকে যায় তার কারণ কী? “২০১১ সালে পরিবর্তনের সময় প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের থেকে বামপন্থীদের সমালোচনা উঠে এসেছিল। যা তৃণমূল কংগ্রেসকে একটা শেড দিয়েছিল। আমি মনে করি না সেই সমালোচনা ফেলে দেওয়ার মতো ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই ব্যক্তিত্বরা সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। অথচ তাঁদের যে কাজ ছিল, অর্থাৎ পরিভাষায় রাজনীতি চালু আছে তার বদল দেওয়া— সেটা যদি লোরকাকে দেখি কিংবা আমাদের দেশে উৎপল দত্তকে দেখি তাহলেও তাই— সেটা কিন্তু তাঁরা করেননি। তাঁরা রাজনীতির পরিভাষাতেই রাজনীতির কথা তুলে এনেছেন। আর সেই জন্যই আজ আমরা যে কাজগুলো করছি সেগুলোকে এত নতুন মনে হচ্ছে।”
আবার, সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্রের কথায়, “আসলে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় মানুষকে ক্রমাগত সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে। আমি মনে করি রাজনীতিই কিন্তু হাতিয়ার। আর সেখানেই গণসঙ্গীত বা প্রোটেস্ট সংয়ের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। তবে এমন অনেক সময় আসে, যখন সেটাকে ভোঁতা মনে হয়। তখন প্রয়োজন হচ্ছে তাকে নতুন করে দেখা, নতুন করে বোঝা। নতুন করে তরুণরা যে গান বাঁধছে সেটা তো আসলে প্রতিবাদেরই স্বর। সেটার খুবই দরকার ছিল।” সলিল চৌধুরীকে তিনি দেখেছেন সামনে থেকেই। গণসঙ্গীতের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন দীর্ঘদিন। তাঁর এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার উঠে আসছে নতুন করে আবার ফিরতে চলেছে গণসঙ্গীত। তার ধারায় বদল এলেও বিন্দুমাত্র টলে যায়নি মেরুদণ্ড।
শুধু প্রথিযজশারাই নয়, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বিভিন্নভাবে অংশ নিচ্ছে গণশিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে। কোথাও দেওয়াল লিখন, কোথাও পথনাটিকা আবার কোথাও রাস্তায় দাঁড়িয়েই সমবেত কণ্ঠস্বর— প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠছে শিল্পই। দেবজ্যোতি মিশ্রের কথাতেও উঠে এল সেই কথাই, “পথে দাঁড়িয়ে অনেক জায়গাতেই হয়তো গলা মেলাচ্ছি আমি। কিন্তু সেটা আমার গান কিনা সেটা বড়ো কথা নয়। প্রত্যেক কবি, প্রত্যেক অ-কবি, প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি অক্ষর আসলে সমবেত কণ্ঠস্বর। এটা আমার নয়, এটা আমাদের ভাষা। আর রাজনীতিতে যদি শিক্ষিত ঝকঝকে তরুণরা না উঠে আসে, তাহলে হবে না।”
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, সাধারণ মানুষের ওপরে কতটা প্রভাব ফেলবে এই ‘সাংস্কৃতিক নবজাগরণ’? সকলেরই অভিমত, হয়তো ভোটবাক্সের চূড়ান্ত ফলাফলে একেবারেই হঠাৎ বদল আসবে না। তবে এই নতুন ধারার গণসঙ্গীত কিংবা বৃহত্তর অর্থে গণশিল্পের হাত ধরেই দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত হবেন সাধারণ মানুষ। এই ধারাই যেন জন্ম দেবে এক নতুন বসন্তের…
Powered by Froala Editor