কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আর কয়েদখানার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই বাস্তবে। স্বাধীনতা নেই কোনো, নেই ব্যক্তিগত পরিসর। তার ওপর নাৎসি সেনাদের অত্যাচার। সব মিলিয়ে এক কথায় যাকে বলে দুর্বিষহ জীবন। তবুও দিনের শেষে ঠিক বন্ধু জুটে যায় এই নরকেও। আসলে সকলেই যে কয়েনের একই পিঠে দাঁড়িয়ে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই আলাপ হওয়া এমনই এক পরিচিতের সঙ্গেই হাসি-ঠাট্টা করছিল ওয়াল্টার।
গল্পের খাতিরেই ধরে নেওয়া এই নাম। বাস্তবে এই যুবকের নামের কোনো নথি পাওয়া যায় না। নাৎসি শাসকদের খাতায় ‘অবজেক্ট’ ছাড়া আর কীই বা হতে পারে একজন ইহুদির পরিচয়? যাই হোক, ফেরা যাক মূল গল্পে। দূর থেকে এক ওয়ার্ডেনকে আসতে দেখে নিজেকে সংযত করে ওয়াল্টার। সেইসঙ্গে খানিকটা আড়ষ্টও হয়ে যাওয়া ভেতর থেকে। তখন কে-ই বা জানত এবার ডাক পড়বে তারই? তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ক্যাম্পের চিকিৎসক আরিবার্ট হাইম। শুনে খানিকটা স্বস্তি পেল ওয়াল্টার। যাক, অন্তত এবারের জন্য রক্ষা পাওয়া গেল নাৎসি জল্লাদদের হাত থেকে।
অথচ তার অজান্তেই অপেক্ষারত ছিল নিয়তি। চেম্বারে ঢুকতেই এক গাল হেসে ওয়াল্টারকে শুয়ে পড়তে বললেন হাইম। আশ্বস্ত করলেন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন তিনি। শুধু নিতে হবে একটাই ইঞ্জেকশন। আর তারপরই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ছুটি মিলবে ওয়াল্টারের। নরকমুক্তি! খুশিতে ভরে গেল ওয়াল্টারের মন। এটুকুই তো কষ্ট সহ্য করা। তাতে ক্ষতি কী? রাজি হয়ে গেল ইহুদি তরুণ। তার বাঁদিকের পাঁজরের ধার ঘেঁষে ইঞ্জেকশনের সূচ ফোটালেন হাইম।
কয়েক মুহূর্ত বাদেই শুরু হল বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা। বন্ধ হয়ে এল শ্বাসও। অন্ধকার নেমে এল দু’চোখে। ছটফট করতে করতে কয়েক মিনিটের মধ্যে নিথর হয়ে গেল শয্যায় শুয়ে থাকা দেহটা। নাৎসি সেনাদের ডেকে হাইম আদেশ দিলেন মৃতদেহটিকে সেদ্ধ করে নিয়ে আসতে। তারপর ছুরি দিয়ে ধর থেকে আলাদা করা হল মাথা। ধারালো ব্লেড দিয়ে করোটি থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া চামড়া, মাংস। খুলির মধ্যে ভরে ফেলা হল পাথর।
আরও পড়ুন
সামনেই মৃত্যু, নাৎসিদের হাতে বন্দি ইহুদি শিশুরা সাহস খুঁজল রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এ
পরবর্তীকালে এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেরই এক বন্দি সবিস্তারে জানিয়েছিলেন আতঙ্কে মোড়া এই অতীতের গল্প। জানিয়েছিলেন ওই ইহুদি যুবকের হাসি দেখে পছন্দ হওয়ায় তার খুলিকে স্মারক হিসাবে পেতে চেয়েছিলেন হাইম। আর সে জন্যই তার হৃদপিণ্ডে ইঞ্জেক্ট করেছিলেন পেট্রোল, জল এবং বিষ। শুধু তাই নয়, পাথর ভরা সেই খুলি পেপার ওয়েট হিসাবে ব্যবহারও করতেন হাইম। আর তার চামড়া দিয়ে তৈরি করেছিলেন চেয়ার।
শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে নিশ্চয়ই? কিন্তু হাইমের নৃশংসতার শেষ এখানেই নয়। মাত্র ২ মাস মাউথাউসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেছিলেন হাইম। আর তাতেই সকলের ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। চলত নৃশংস পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কখনো অ্যানেস্থেসিয়া না করেই অপারেশন করতেন হাইম। আবার কখনও শরীরের ব্যবচ্ছেদ করে বের করে আনা হত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আর স্টপওয়াচ চালিয়ে হাইম পর্যবেক্ষণ করতেন ঠিক কতক্ষণ লাগছে একজন বন্দির মৃত্যু হতে।
আরও পড়ুন
দেশজুড়ে নাৎসিদের তাণ্ডব, ৮৩ জন ইহুদি শিশুর প্রাণ বাঁচালেন ফ্রান্সের সন্ন্যাসিনী
শুধু দু’মাসে দুই শতাধিক এমন কাজ করেছেন হাইম। প্রতিটি ‘অবজেক্ট’-এর পরীক্ষার তথ্য তিনি নথিভুক্ত করেছিলেন নিজের খাতায়। এর পর ফিনল্যান্ডের মাউন্টেন ডিভিশন নর্ডের ওউলু হাসপাতালে নিয়োজিত হয়েছিলেন হাইম। সেখানেও চলত একইরকম বর্বরতা। অল্প সময়েই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘ডক্টর ডেথ’ নামে।
১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন হাইম। যুদ্ধবন্দি হিসাবে তাঁকে পাঠানো হয় ক্যাম্পে। যদিও খুব বেশদিন বন্দি থাকেননি হাইম। বছর খানেকের মধ্যেই ছাড়া পান তিনি। তারপর তিনি আবার ফিরেছিলেন চিকিৎসায়। পশ্চিম জার্মানির ছোট্ট শহর বাডেন বাডেনে গাইনোকোলজিস্ট হিসাবে চালাতেন একটি ক্লিনিক।
আরও পড়ুন
ইহুদি-নিধন তরান্বিত করছিল মহামারী, থামালেন নাৎসি ক্যাম্পে বন্দি চিকিৎসকরাই
১৯৬১ সালে বিশ্বযুদ্ধের একটি ট্রায়ালে মাউথাউসেন ক্যাম্পের এক বন্দি আদালতে উল্লেখ করেন হাইমের কথা। বিবরণ দিয়েছিলেন তাঁর নৃশংসতার। আর তারপরেই নড়েচড়ে বসে জার্মান প্রশাসন। অনুসন্ধানের পর উদ্ধার করা হয় হাইমের সমস্ত নথি। পুনরায় কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয় হাইমকে। তবে সংবাদমাধ্যমে আগেই এর আভাস পেয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৬২ সাল থেকে নিরন্তর তাঁর খোঁজ চালিয়ে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা। তল্লাশি চলেছিল স্পেন থেকে শুরু করে ল্যাটিন আমেরিকা পর্যন্ত। তাঁর মাথার দাম ছিল ৩ লক্ষ ইউরো। এমনকি ২০০৭ সালেও প্রসঙ্গ উঠেছিল হাইম জীবিত আছেন। এবং আর্জেন্টিনা বা চিলিতে রয়েছেন তিনি। তবে অনেক অনুসন্ধানের পরেও ধরা যায়নি তাঁকে।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের শেষতম বিচারে কারাদণ্ড ৯৩ বছরের নাৎসি বৃদ্ধের; জড়িয়ে ছিলেন ইহুদি হত্যায়
২০০৮ সালে তাঁর দুই পুত্র দ্বারস্থ হন আদালতের। তাঁরা দাবি করেন ব্যাঙ্কে থাকা হাইমের অর্থ-সম্পত্তির। জানান, মিশরে ১৯৯২ সালে প্রয়াত হয়েছেন হাইম। সেই সূত্র ধরেই নতুন করে অনুসন্ধান চালান হয় মিশরে। তদন্তে উঠে আসে, শেষ বয়সে মিশরেই ছিলেন তিনি। তারেক ফারিদ হোসেন নামে আস্তানা গেড়েছিলেন সেখানে। কায়রোর অঞ্চলিক মানুষরাই ছবি দেখে চিহ্নিত করেন তাঁকে। তবে চিলি, আর্জেন্টিনাতেও বেশ কিছুদিন তার আগে গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন হাইম। ভিন্ন ভিন্ন নামে।
তবে হাইমের মৃত্যুর পরেও শেষ হয়নি মামলা। আশির দশকে বার বার তাঁর পরিবারের কাছে প্রশাসন দ্বারস্থ হওয়ার পরেও, জানানো হয়েছিল হাইমের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তাঁদের। পরে জানা যায়, পরিবারে প্রায়শই টাকা পাঠাতেন হাইম। ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। ২০১২ সালে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য জার্মান আদালতে মামলা রুজু হয় তাঁর দুই পুত্রের নামে। এখনও পর্যন্ত চলছে সেই মামলা। বিশ্বযুদ্ধের সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে এসে, আজ হাতে গোনা কিছু মানুষ জীবিত রয়েছেন তৎকালীন সময়ের। আজও তাঁদের বিভীষিকার মতোই তাড়া করে বেড়ায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দিনগুলো…
Powered by Froala Editor