গ্রামজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাপ। কখনও মানুষের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এমনকি শয়নকক্ষেও তার অবাধ বিচরণ। অথচ কেউ ভয় পাচ্ছেন না। সাপেরা তাঁদের আক্রমণ করবে না, এই বিষয়ে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত। আর মানুষও তাই এখানে সাপেদের আক্রমণ করে না। যে-কোনো সাপ অবশ্য নয়। পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট এবং ভাতার ব্লকের পাঁচটি গ্রামে দেখা মেলে ঝঙ্কেশ্বরী নামে বিশেষ একপ্রকার সাপের। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এই সাপ মানুষকে কাটে না। শুধু বছরে একটিবার পুজো পেলেই সন্তুষ্ট দেবী ঝঙ্কেশ্বরী।
পাশাপাশি ৬টি গ্রাম – নিগন, শিকত্তর, মুসারু, পলশনা, বড়পোষলা এবং ছোটপোষলা। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের কৃষ্ণা-প্রতিপদ তিথিতে এই পাঁচটি গ্রামে পূজিতা হন দেবী ঝঙ্কেশ্বরী। গ্রামবাসীদের মুখে মুখে যিনি ঝাঁকলাই নামেই অধিক পরিচিত। “বাংলার নানা প্রান্তে দেবী মনসা নানা রূপে পূজিতা হন। কোথাও বিষহারিণী, কোথাও সর্পেশ্বরী। তেমনই এই ছয়টি গ্রামে তাঁর নাম ঝঙ্কেশ্বরী।” বলছিলেন লৌকিক ইতিহাসের গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী। তবে এই পুজোর সঙ্গে মনসাপুজোর প্রচলিত রীতি মেলে না একেবারেই। এমনকি নাগপঞ্চমী তিথিতেও পুজো হয় না এখানে। এই দেবীর আসল পরিচয়ই বা কী? গ্রামবাসীদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, দাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ কালিয়া নাগকে দমন করে হত্যা করেননি। তাঁকে বিষহীন করে নির্বাসন দিয়েছিলেন এই অঞ্চলে। অবশ্য এই কথার সমর্থনে কোনো পৌরাণিক নথি পাওয়া যায় না। তবে বর্ধমান জেলার জনৈক কালিদাসের লেখা মনসামঙ্গল থেকে জানা যায়, চাঁদ সদাগরপুত্র লখিন্দরকে দংশন করার পর কালনাগিনী নির্বাসিত হয়েছিলেন পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে। আর এই পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলেই রয়েছে মুসারু গ্রাম।
“আসলে মঙ্গলকাব্যের কবিরা সবসময় তাঁর আশেপাশের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গেই মিলিয়ে নিয়েছেন কাব্যের লেখাকে। চাঁদ সদাগরের চম্পাই নগরীর ঠিকানাও পাওয়া যায় বাংলার নানা প্রান্তে। ঠিক তেমনই বর্ধমানের পানাগড়ের দক্ষিণেও আছে এই নামের একটি গ্রাম।” বলছিলেন যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলের বর্ণনা অবশ্য শুধু মনসামঙ্গলেই পাওয়া যায় না। কৃত্তিবাসী রামায়ণে ক্ষীরগ্রামকে বলা হয়েছে পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল। সেটিও নিগন গ্রাম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আবার ঝঙ্কেশ্বরী নামের সঙ্গে জাঙ্গুলি দেবীর নামের ভাষাতাত্ত্বিক মিলের কথাও বলেন অনেকে। বৌদ্ধধর্মের এই দেবীও সাপেদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ফলে ঝঙ্কেশ্বরী পুজোর সঙ্গে বৌদ্ধধর্মেরও যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও পুজোর সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে লোকমুখে প্রচলিত পাঁচালিতে বলা হয়েছে, ‘ন শো এগারো সনে কৃষ্ণা প্রতিপদে/ প্রথম বরিখা কালে পড়িয়া বিপদে/ আগমন হন দেবী খুনগড় ডাঙ্গায়’। সেই হিসাব অনুযায়ী এই পুজো প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন।
প্রায় ৫ দশক আগে রাজ্য বনবিভাগের একদল প্রাণীবিশেষজ্ঞ ঝঙ্কেশ্বরী সাপের চরিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছিলেন, আসলে কেউটে সাপেরই একটি উপপ্রজাতি এই ঝঙ্কেশ্বরী। দৈহিক গঠনে পার্থক্য শুধু মাথার পিছনের চক্রে। সাধারণ কেউটে সাপের চক্র আকারে খানিকটা বড়ো এবং তা সাপের ঘাড়ের কাছে অবস্থিত। কিন্তু ঝঙ্কেশ্বরীর চক্র ছোটো এবং তা একেবারে ফণার মাঝে অবস্থিত। যদিও এর বিষ সাধারণ কেউটে সাপের চেয়েও তীব্র। তাহলে কি শুধুই মানুষের বিশ্বাসের জোর এতদিন রক্ষা করে এসেছে সকলকে? শোনা যায়, দুর্ঘটনা বশত যদি সাপ কখনও কাউকে কামড়ায় তাহলে মুসারু গ্রামের বিষ পুস্করিণীর জলে স্নান করলেই বিষমুক্তি ঘটে।
আরও পড়ুন
১৫০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে ধ্বংসের দিন গুনছে চন্দ্রকোণার শীতলা মন্দির
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঝঙ্কেশ্বরী সাপের কামড়ে মৃত্যুর একাধিক ঘটনাও শোনা গিয়েছে। আবার অনেকেরই কিছু হয়নি। চিকিৎসকদের মতে, সাপ কামড়ালেই সবসময় বিষ ঢালে না। চরম বিপন্ন বোধ করলেই তারা বিষ ঢালে। তাই এখানে লৌকিক বিশ্বাসের চেয়েও বড়ো কথা মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান। অবশ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই সহাবস্থানের ধারাকে ধরে রেখেছে ধর্মীয় বিশ্বাস। কিন্তু উন্নয়নের কোপে সেই প্রকৃতি-সংস্কৃতিতেও ছেদ পড়েছে। আজ নিগন এবং শিকত্তর গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঝঙ্কেশ্বরী সাপ। বাকি তিনটি গ্রামেও ক্রমশ সংখ্যা কমে আসছে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারই এর জন্য দায়ী, এমনটাই মনে করছেন গ্রামবাসীরা। আর কৃষিকাজই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামবাসীর জীবিকা। জৈব পদ্ধতিতে চাষ-আবাদের উন্নতি প্রযুক্তি আজও তাঁদের অধরা। তাই বাধ্য হয়েই বাজারে টিকে থাকার তাগিদে রাসায়নিক সারই ব্যবহার করেন তাঁরা। সাপ ও মানুষের সহাবস্থানের ছবিটা আজ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। শুধু পুজোর রীতিটা থেকে গিয়েছে এখনও। গত শনি ও রবিবার একইরকম জাঁকজমক সহকারে অনুষ্ঠিত হল ঝঙ্কেশ্বরী পুজো। কিন্তু যে জীবন হারিয়ে যেতে বসেছে, তাকে কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? আর এই বিরল প্রজাতির সাপের সংরক্ষণের বিষয়েও কি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কোনোদিন?
আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গপথে যাওয়া যেত রাজবাড়ি! শোভাবাজারের লাল মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত ইতিহাস
তথ্যঋণঃ নয়ন চক্রবর্তী, ঝঙ্কেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত, মুসারু গ্রাম
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিলুপ্তপ্রায় নকশার হদিশ মন্দির প্রাঙ্গণে, ‘আদু হুলি’ খেলার আড়ালে লুকিয়ে কোন ইতিহাস?