ইংল্যান্ডের (England) কেমব্রিজের সাসেক্স কলেজে গেলে চোখে পড়বে একটি আশ্চর্য ফলক। যেখানে লেখা, ১৯৬০ সালের ২৫ মার্চে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ডের ‘লর্ড প্রটেক্টর’ অলিভার ক্রমওয়েলের (Oliver Cromwell) মাথা। প্রশ্ন উঠতে পারে কে এই অলিভার? সেক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম ‘গণতান্ত্রিক’ নেতা। ১৬৫৮ সালে মৃত্যু ঘটে তাঁর। কিন্তু তাতে সমস্যা বাড়ে বই কমে না। শুধু মাথাটিকেই কেন সমাধিস্থ করা হল এখানে? আর তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল তাঁর মাথা?
উত্তরের খোঁজে ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে, যখন ইংল্যান্ডে চলছে রাজতন্ত্রের সঙ্গে পার্লামেন্টের বিরোধ। অস্থিরতার সূচনা অবশ্য হয়েছিল ১৬০৩ সালে রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পরেই। তারপর একে একে রাজা হয়েছেন প্রথম জেমস, প্রথম চার্লস প্রমুখ। একে তো স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে রাজকোষের অবস্থা শোচনীয়, তার মধ্যে দুজনেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন পার্লামেন্টের সঙ্গে। রাজা জেমস ছিলেন প্রোটেস্টান্ট, অন্যদিকে পার্লামেন্টের সদস্যরা ছিলেন চার্চের শোধনকামী পিউরিটান। ফলে ঢুকে পড়ে ধর্মীয় সংঘাতও। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এমন একটা স্তরে পৌঁছোয় যে রাজা প্রথম চার্লস পুরোপুরি ভেঙে দেন পার্লামেন্টকেই। দীর্ঘ এগারো বছর চলে এই অবস্থা। নানা উত্থানপতনের পর অবশেষে ১৬৪৯ সালে মুণ্ডচ্ছেদ করা হয় চার্লসের।
তারপরের চার বছর পার্লামেন্টের পক্ষ থেকেই চলল দেশের শাসনবিধি। এক অর্থে ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা। ১৬৫৩ সালে সে দলের মুখ নেতা অলিভার ক্রমওয়েলের হাতে ‘লর্ড প্রোটেক্টর’ রূপে তুলে দেওয়া হয় ইংল্যান্ডের কর্মভার। ক্ষমতায় ওঠার যাত্রাটা শুরু হয়েছিল অবশ্য অনেক আগে থেকেই। ১৫৯৯ সালে জন্ম তাঁর। তিরিশ বছর বয়সে পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার সময় তিনি একেবারে গোঁড়া পিউরিটান। মহান ইংল্যান্ড ও তার চার্চকে রোমান ক্যাথলিকদের হাত থেকে মুক্ত করাই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। ক্রমে রাজার সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রে পার্লামেন্টের হাতে থাকা সামরিক ক্ষমতার পুরোটাই প্রায় চলে আসে তাঁর হাতে। দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেন সব কিছু। সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক রাজা হওয়ার জন্য তিনি ছিলেন যোগ্য ব্যক্তি।
তাঁর আমলে দেশের সেনাবাহিনীতে পরিবারতন্ত্রের বদলে চালু হয় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ। কথিত যে, তিনি নাকি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন ক্রিসমাস পালন। মহিলাদের স্বাধীনতাও অনেক হ্রাস হয় তাঁর সময়ে। ১৬৫৮ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। কারোর মতে তিনি আক্রান্ত ছিলেন কিডনির রোগে, কেউ-বা বলেন ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সে যাই হোক, মহা ধুমধাম করে দেহ সমাধিস্থ করা হল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। এরপর রাজা হলেন তাঁর পুত্র রিচার্ড। কিন্তু যোগ্যশাসনের অভাবে শিথিল হতে থাকল প্রতিবেশী দেশগুলির উপর জোর, দেশের মধ্যেও বাড়তে থাকে শত্রু। ন-মাসের মধ্যে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে দায়িত্ব নেয় পার্লামেন্ট। নিজেরাই সাড়ম্বরে ফিরিয়ে আনে প্রথম চার্লসের পুত্র দ্বিতীয় চার্লসকে।
আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডের বাজার ছেয়ে গেছিল জাল নোটে, নেপথ্যে এক জার্মান ‘অপারেশন’
ইংল্যান্ডে ফের প্রতিষ্ঠিত হল রাজতন্ত্র। সিংহাসনে বসেই রাজা চার্লস দিলেন এক অদ্ভুত আদেশ। কবর থেকে তুলে এনে শাস্তি দেওয়া হবে ক্রমওয়েলকে। যেমন কথা, সেরকম কাজ। ১৬৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ক্রমওয়েলের পচাগলা দেহটিকে চড়ানো হল ফাঁসিতে। পাশেই ঝুলে রইলেন দুই মৃত সঙ্গী হেনরি আয়ারটন আর জন ব্র্যাডশ। ঘটনাচক্রে সেদিন ছিল প্রথম চার্লসের মুণ্ডচ্ছেদের দ্বাদশ বছর পূর্তি। বাকি শরীরটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কবরে। প্রকাশ্যে রাস্তায় শুধু ঝুলতে থাকে ক্রমওয়েলের কাটা মুন্ডু। তারপর একটা লৌহদণ্ড মাথার মধ্যে লম্বালম্বি করে ঢুকিয়ে, চেনে বেঁধে ওয়েস্টমিনস্টারে রেখে দেওয়া হয় কুড়ি বছর। রাজদ্রোহিতার চূড়ান্ত শাস্তি!
আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম দাঁড়-টানা নৌকার পরিষেবা
আর সেভাবেই একদিন হারিয়ে গেল মুন্ডুটি। শোনা যায়, এক প্রবল ঝড়ে নাকি সেটি উড়ে আসে এক প্রহরীর সামনে। তাঁর মৃত্যুর পর বেচে দেওয়া হয় মাথাটি। এখান থেকে শুরু হয় ক্রমওয়েলের দুটি মাথার গল্প। অর্থাৎ, দুপক্ষ থেকে দাবি করে যে তাদের কাছেই আছে প্রকৃত মুন্ডু। শতকের পর শতক ঘুরে অবশেষে ১৯৬০-এ কেমব্রিজে ফিরে আসেন তিনি। অবশ্য এখনও অনেকে মনে করেন, এই মুন্ডু আদৌ ক্রমওয়েলের নয়। তাঁর মাপের একটি মুখোশের ছাঁচে ফেলে হয়েছে পরীক্ষা। তৈরি হয়েছে অসংখ্য গুজব। তাতে অবশ্য ক্রমওয়েল সাহেবের কিছু যায়ে আসে না। ইংল্যান্ডের পুতুলের মতো ‘রাজতন্ত্র’ দেখে বড়োজোর ঠোঁট বেঁকিয়ে একটু হেসে উঠতে পারে তাঁর নিঃসঙ্গ মুন্ডুটি।
Powered by Froala Editor