সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রতটে পুরনো মুদ্রা, আংটি, এমনকি বোতলবন্দি চিঠিও খুঁজে পেয়েছেন অনেকেই। কিন্তু সমুদ্রভ্রমণে বেরিয়ে যদি আস্ত জাহাজ খুঁজে পান? শুনতে খানিক আশ্চর্য লাগলেও সত্যি। ১৮৭২ সালে ঘটেছিল এমনটাই। মাঝ-সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আস্ত একটি জাহাজ খুঁজে পেয়েছিলেন অন্য একটি জাহাজের নাবিকরা। বিশ্বের অন্যতম জাহাজ-রহস্যের তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকে এই আশ্চর্য ঘটনার নাম।
ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ৫ ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পাড়ি দিয়েছিল ব্রিটিশ জাহাজ ‘ডেই গ্রাসিয়া’। আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে এগিয়ে যাওয়ার সময়ই আজর দ্বীপের কাছে একটি রহস্যময় জাহাজকে ভেসে থাকতে দেখেন ‘ডেই গ্রাসিয়া’-র ক্যাপ্টেন। মন্থর গতি দেখেই তিনি ঠাহর করেছিলেন বড়ো কোনো সমস্যায় পড়েছে এই জাহাজ। কিন্তু কী সেই সমস্যা? না, বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যেতে পারেননি তিনি। বরং, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে মাঝ-সমুদ্রে ভাসমান জাহাজটিতে বিশেষ দল পাঠান তিনি। আর তাতে যে-দৃশ্য প্রকাশ্যে আসে, তা রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয় তাঁকে।
পাল টাঙানো রয়েছে জাহাজের। জাহাজের মধ্যে মজুত রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য এবং পানীয়। অন্ততপক্ষে তা দিয়ে খান দশেক মানুষের খিদে-তৃষ্ণা মিটবে মাস ছয়েক। তাছাড়াও পণ্য হিসাবে রয়েছে প্রায় ১৭০০ ব্যারেল অপরিশোধিত অ্যালকোহল। রয়েছে নাবিকদের ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ এবং অন্যান্য সামগ্রীও। শুধু মানুষের দেখা নেই কোনো। আর নেই একটি লাইফবোট। কিন্তু এই মাঝ-সমুদ্রে কোথায় গেলেন এই জাহাজের মানুষজন, নাবিকরা? কেনই বা পরিত্যক্ত করা হল এই জাহাজকে?
আটলান্টিকের মাঝে পরিত্যক্ত এই জাহাজের পরিচয় ‘মেরি সেলেস্ট’ (Mary Celeste)। আর তার নাবিকদের এই রহস্যময় অন্তর্ধানের কাহিনি পরিচিত ‘মেরি সেলেস্ট মিস্ট্রি’ নামে। অবশ্য এই ঐতিহাসিক ঘটনা অর্থাৎ মেরি সেলেস্টের ‘ঘোস্ট শিপ’ হয়ে ওঠার বহু আগে থেকেই ‘অভিশপ্ত’ (Cursed Ship) তকমা পেয়েছিল এই জাহাজটি।
১৮৬০ সালের শেষের দিক সেটা। নোভা স্কোশিয়ার স্পেনশর দ্বীপে তৈরি হয় এই জাহাজটি। অবশ্য তখন তার নাম ছিল ‘আমাজন’। তবে সমুদ্রে নামার পর থেকে একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হয় এই জাহাজ। সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা সত্ত্বেও, আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই জাহাজের প্রথম ক্যাপ্টেন। এই ঘটনার পর মাঝ-সমুদ্রে একবার অলৌকিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন জাহাজের সমস্ত কর্মীরাই। তাছাড়াও ইংলিশ চ্যানেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটিয়ে বসেছিল ‘আমাজন’।
‘আমাজন’-এর এই অভিশাপ মুছে ফেলতেই নতুন করে তার নাম দেওয়া হয় ‘মেরি সেলেস্ট’। পাশাপাশি তা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল এক মার্কিন ব্যবসায়ীকে। ১৮৭২ সালে সেই ব্যবসায়ীর হয়েই এই জাহাজ নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিগস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে জাহাজ ছেড়েছিল ১৮৭২-এর ৭ নভেম্বর। গন্তব্য ইতালির জিনোয়া। যাত্রী বলতে মাত্র ১০ জন। ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন, তাঁর স্ত্রী, দু’বছর বয়সি কন্যাসন্তান এবং ৭ জন নাবিক। তবে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান তাঁরা সকলেই। এমনকি মাঝ-সমুদ্রে ছেড়ে যান পণ্য-বোঝাই আস্ত জাহাজটিও।
‘ডেই গ্রাসিয়া’-র নাবিকরা জাহাজ থেকে খুঁজে পাওয়া বেশ কিছু ডায়েরি ও নথি থেকে জানান, মাঝসমুদ্রে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হয়েছিল ‘মেরি সেলেস্ট’। তবে সেই দুর্যোগেও বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়নি এই জাহাজের। তবে কেন পরিত্যক্ত হল জাহাজটি? আর মানুষরাই বা গেলেন কোথায়?
নানা জন নানা তত্ত্ব তুলে এনেছেন এই রহস্যের প্রেক্ষিতে। অনেকে দাবি করেন, দুর্ঘটনাবশত কোনোভাবে আগুন ধরে গিয়েছিল এই জাহাজে। এদিকে জাহাজের মধ্যে বোঝাই করা রয়েছে ১৭০০ ব্যারেল অ্যালকোহল। ফলে বড়ো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় লাইফবোটে চেপে জাহাজ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সকলে। কিন্তু তা-ই যদি হয় তবে সেই আগুন নিভল কীভাবে? কেন-ই বা ক্ষয়ক্ষতি হল না কোনো ‘মেরি সেলেস্ট’-এর? আবার কেউ দাবি করেন মাঝ-সমুদ্রে জলদস্যুদের হামলার শিকার হয়েছিল এই জাহাজ। সেক্ষেত্রেও খাদ্য, পানীয় ও অ্যালকোহল না-থাকার কথা। এসবের বাইরে কেউ কেউ অলৌকিক শক্তি এমনকি সমুদ্র-দানবের আক্রমণের কথাও উল্লেখ করেন এই ঘটনার প্রেক্ষিতে।
এমনকি এই ঘটনা তৎকালীন সময়ে এতটাই সাড়া ফেলে দিয়েছিল ইউরোপজুড়ে যে ১৮৮৪ সালে এই রহস্যকে প্রেক্ষাপট করে কলম ধরেন স্বয়ং শার্লক-স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল। আস্ত একটি গল্প লিখেছিলেন তিনি। সেই গল্পে ব্যবহৃত হয়েছিল বহু সত্যিকারের তথ্য। অর্থাৎ, যে-তথ্য প্রকাশ্যে এসেছিল ব্রিটিশ জাহাজটির কর্মীদের মাধ্যমে। দীর্ঘ সময় ধরে এই গল্পকেই মেরি সেলেস্ট রহস্যের প্রামাণ্য নথি হিসাবে ধরে নেওয়া হত। তবে এই রহস্যের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব প্রকাশ্যে আসে চলতি শতকেরও শুরুতে। নেপথ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতা অ্যানি ম্যাকগ্রেগর।
২০০২ সালে মেরি সেলেস্টের ওপর আস্ত একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন অ্যানি। তার জন্য বিস্তর গবেষণাও করেছিলেন তিনি। সেই সূত্রেই ‘ডেই গ্রাসিয়া’-র এক নাবিকের লেখা ও বেশ কিছু তৎকালীন সংবাদপত্র পড়তে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন জাহাজের মধ্যে জল জমে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। ম্যাকগ্রেগরের অনুমান, কোনোভাবে আটকে গিয়েছিল মেরি সেলেস্টের জল নিষ্কাশনের পাইপ। ফলে জল জমে জাহাজডুবি হওয়ার আশঙ্কাতেই লাইফবোটে চেপে জাহাজ পরিত্যাগ করেছিলেন নাবিকরা। তবে আটলান্টিকের উত্তাল সমুদ্রই প্রাণ কেড়ে নেয় তাঁদের। কিংবা নিকটবর্তী কোনো দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু আর মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসা হয়নি তাঁদের। আর ‘মেরি সেলেস্ট’? শেষ অবধি কী পরিণতি হয়েছিল এই জাহাজের?
‘ডেই গ্রাসিয়া’-র নাবিকরাই এই জাহাজকে চালিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটেনে। পরবর্তীতে যা নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয় এক ব্রিটিশ সংস্থাকে। ১৮৭২-এর সেই রহস্যময় দুর্ঘটনার পরেও দিব্যি ১২ বছর সমুদ্রপথে যাতায়াত করেছে ‘মেরি সেলেস্ট’। এর মাঝে অবশ্য বহুবার বদলেছে তার মালিকানা। শেষ পর্যন্ত ১৮৮৪ সালে একটি বীমা জালিয়াতির কারণে হাইতিতে বাজেয়াপ্ত করা হয় এই জাহাজটিকে। সেখানেই দীর্ঘদিন পড়ে থাকতে থাকতে অকেজ হয়ে পড়ে মেরি সেলেস্ট। ভেঙে ফেলা হয় জাহাজটিকে। তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। তবুও গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্র এবং সর্বোপরি মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে ‘অভিশপ্ত’ এই জাহাজের কাহিনি।
Powered by Froala Editor