পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের কথা জানা আছে সকলেরই। কিন্তু তার বাইরেও বেশ কিছু প্রাকৃতিক অঞ্চল এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্যকেও সপ্তম আশ্চর্যের তুলনাযোগ্য হিসাবে গণ্য করে ইউনেস্কো। যেগুলি অলিখিতভাবেই পরিচিত ‘অষ্টম আশ্চর্য’ হিসাবে। রাশিয়ার পুশকিনে অবস্থিত ‘অ্যাম্বার রুম’ এমনই এক অষ্টম আশ্চর্য। তবে পুস্কিনের ক্যাথলিন প্যালেসে আজ যে ‘অ্যাম্বার রুম’ দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার বয়সমাত্র ১৮ বছর। ফলত প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কীভাবে ‘ঐতিহাসিক’-এর পর্যায়ে পড়ছে এই নবনির্মিত স্থাপত্য? আর সেই জায়গাতেই লুকিয়ে রয়েছে এক রহস্যময় ইতিহাস।
উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় তিন শতক। ১৭০০ সাল। রাশিয়ায় তখন রাজত্ব চলছে প্রথম জার পিটার দ্য গ্রেটের। বয়স তাঁর মাত্র ১৯ বছর। তবে তাঁর প্রতাপ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চলেই। রাশিয়াতেও শিল্পবিপ্লব আনতে তিনি পরিচয় গোপন করেই ঘুরে এসেছেন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স। হল্যান্ডের বেশ খানিকটা চলে এসেছে তাঁর দখলে। সুইডেনের সঙ্গে চলছে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ। ঠিক সেই সময়ই জন্ম অ্যাম্বার রুমের। তবে তা রাশিয়ায় নয় প্রুশিয়ায়।
প্রুশিয়ার রাজা প্রথম ফ্রেডরিক শার্লটনবার্গ প্রাসাদে প্রাথমিকভাবে শুরু করেছিলেন এই নির্মাণ প্রকল্প। স্ত্রী সোফি-শার্লট ছিলেন শিল্প-সাহিত্য-ভাস্কর্যের অনুরাগী। তাঁর উপহার হিসাবেই এই অ্যাম্বার রুম নির্মাণ করেছিলেন প্রথম ফ্রেডরিক। জার্মান স্থপতি আন্দ্রেয়াস স্লাটারকে দায়িত্ব দেওয়া হল নীল নকশা তৈরির। আর সেই নকশা অনুযায়ীই ড্যানিশ কারিগর গটফ্রিড ওলফ্রাম তৈরি করে ফেললেন অ্যাম্বার দিয়ে তৈরি একটি সম্পূর্ণ ঘর। অ্যাম্বার বলতে সহজ কথায় গোমেদ বা পোখরাজ জাতীয় একটি হলুদাভ স্বচ্ছ উজ্জ্বল স্ফটিক পাথর। ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? যে পাথর থেকে বের করে আনা হয়েছিল ডাইনোসরের ডিএনএ। সেই পাথরই মূলত অ্যাম্বার।
তবে অ্যাম্বার সজ্জিত এই ঘরের পূর্ণ রূপ দেখে যেতে পারেননি ফ্রেডরিক এবং তাঁর স্ত্রী। ১৭১৩ সালেই মৃত্যু হয় তাঁদের। নতুন রাজা হিসাবে মসনদে বসেন ফ্রেডরিক উইলিয়াম। তবে এই ধরণের নির্মাণকে ‘অযথা খরচ’ বলেই মনে করতেন তিনি। কাজেই বন্ধ করে দেন এই প্রাসাদ নির্মাণের কাজ। বছর তিনেক পর ১৭১৬ সালে প্রুশিয়া ভ্রমণে আসেন রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেট। বিভিন্ন রত্নপাথর, বিশেষত অ্যাম্বারের প্রতি আলাদা আকর্ষণ ছিল পিটারের। পিটার অর্ধনির্মিত এই প্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হওয়ায় নতুন পরিকল্পনা ফেঁদে বসেন ফ্রেডরিক উইলিয়াম। দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাশিয়ান জারের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য, পিটারকে এই ঘর উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কাজও হত তেমন। ১৭১৭ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ। আর তারপরেই বিশালাকার ১৮টি বাক্সে করে আলাদা আলাদা করে অ্যাম্বার রুম স্থানান্তরিত হয়ে গেল রাশিয়ায়। সেন্ট পিটার্সবার্গে।
আরও পড়ুন
পিরামিডের নিচেই রয়েছে আস্ত গোলকধাঁধা, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আশ্চর্য নজির মিশরে
১৯৫৫ সালে জারিনা এলিজাবেথ পুশকিনের ক্যাথরিন প্রাসাদে স্থানান্তরিত করেন এই অ্যাম্বার রুম। ইতালীয় ভাস্কর বার্তোলমি-কে দিয়ে বেশ কিছু পরিবর্তনও করা হয়েছিল এই ঘরে। সোনার পাতে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক জায়গাই। ঐতিহাসিকদের অনুমান, পুরো ঘরটি তৈরি হতে তৎকালীন সময়ে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৪২০ কোটি মার্কিন ডলার।
১৯৪১ সালের ২২ জুন, হিটলারের নির্দেশে রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানি। অপারেশন বার্বারোসাতে প্রায় ৩০ লক্ষ নাৎসি সেনা পৌঁছেছিল রাশিয়া প্রদেশে। লুঠ করা হয়েছিল উল্লেখযোগ্য শিল্পকলা, গুপ্তধন। মিউজিয়ামের কিউরেটররা ওয়ালপেপারের মোড়কে অ্যাম্বার রুম লুকানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই তা খুঁজে বের করে নাৎসি বাহিনী। অ্যাম্বার রুমের স্থপতি এক জার্মান শিল্পী হওয়ায়, তাঁদের বিশ্বাস ছিল এই শিল্প খোদ জার্মানিরই। অথচ তা এতদিন অধিকৃত ছিল রাশিয়ার। ফলে পৃথক করে ফেলা হয় অ্যাম্বার রুমের অংশগুলি। তারপর ২৭টি বাক্সে চেপে তা পাড়ি দেয় জার্মানির কনিগসবার্গে।
আরও পড়ুন
১৮২০-তে ফায়ার সার্ভিস শুরু কলকাতায়, ‘দমকল’ নামের পিছনে লুকিয়ে এক আশ্চর্য গল্প
বছর দুয়েক সেখানেই কনিগসবার্গ দুর্গেই ছিল এই ঘর। তারপর ১৯৪৩ সালে মিত্রশক্তির বোমাবর্ষণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় গোটা শহরটিই। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায় অ্যাম্বার রুমের অস্তিত্ব। তবে অ্যাম্বার রুমের কোনোরকম ধ্বংসচিহ্নই উদ্ধার করা যায়নি ওই দুর্গ থেকে। তা একপ্রকার রহস্যই। যাকে কেন্দ্র করেই রয়েছে একাধিক তত্ত্ব।
কারোর বিশ্বাস, বোমাবর্ষণের সম্ভাবনা টের পাওয়ায় আগেই ক্রেটে বোঝাই করে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল অ্যাম্বার রুমকে। বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে অর্থের চাহিদা যোগাতে তা ব্যবহার করে ফেলেছিলেন হিটলার। আবার কারোর মতে জাহাজে সেই ক্রেট নিয়ে যাওয়ার সময় তলিয়ে গিয়েছিল বাল্টিক সাগরের গর্ভে। ১৯৯৭ সালে একদল জার্মান গোয়েন্দা এক নতুন তত্ত্ব খাড়া করেন। রাশিয়ার ব্রেমেনের এক নিহত সৈনিকের বাড়িতে তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন একটি মোজাইকের প্যানেল। যার সঙ্গে হুবহু সাদৃশ্য রয়েছে অ্যাম্বার রুমের। আর তার পরেই তাঁরা দাবি করেন, জার্মানির লুঠ করা অ্যাম্বার রুম আসলে ছিল নকল। আসলটি বিভিন্ন অংশে ভাগ করে গোটা রাশিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন স্তালিন।
আরও পড়ুন
মর্ত্যেই রয়েছে ‘কৈলাস’, কলকাতার বুকে আশ্চর্য কীর্তি মহারাজা জয়নারায়ণের
এখানেই শেষ হতে পারত রহস্যের। তবে আরও এক উদ্ভট গল্প জুড়ে রয়েছে এই স্থাপত্যের সঙ্গে। গল্প না বলে, বাস্তব বলাই হয়তো ঠিক হবে। এই ঘরের রহস্য উন্মোচনে জড়িত সকল গবেষক এবং অনুসন্ধানকারীই মারা গেছেন অস্বাভাবাবিকভাবে। কেউ খুন হয়েছেন, কেউ বা নিহত হয়েছেন গাড়ি দুর্ঘটনায়।
বর্তমানে যে অ্যাম্বার রুমটির দেখা মিলবে রাশিয়ায়, সেই অনুকরণ তৈরি হয়েছিল ২০০৩ সালে। নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ ডলার। ২০০৩ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন এবং তৎকালীন জার্মান চান্সেলর জেরহার্ড শ্রডার উদ্বোধন করেন এই অ্যাম্বার রুমের। তিনশো বছর আগে যে স্থাপত্য রাশিয়া এবং প্রুশিয়ার মিত্রতার প্রতীক ছিল, আর তা শান্তির বার্তা বহন করে জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে। শুধু মধ্যবর্তী সময়টুকুই সাক্ষী থেকে গেছে রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের। বুনে রেখেছে সমাধান না হওয়া এক রহস্যের মায়াজাল। যা সপ্তম আশ্চর্যের থেকে কোনো অংশে কম নয়...
Powered by Froala Editor