দুর্ভেদ্য অরণ্যের মধ্যে শ্বেতপাথরে নির্মিত এক শহর। প্রশস্ত রাস্তার দু’ধারে সাজানো বিশাল বিশাল প্রাসাদ-প্রমাণ বাড়ি, মন্দির। আর শহরের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত সোনার তৈরি প্রকাণ্ড এক বানরমূর্তি। তবে রত্নখচিত এই শহর অভিশপ্ত। সেখানে পা দিলেই ঘনিয়ে আসে মৃত্যু। ফিরে আসা হয় না অভিযাত্রীদের। আর যদি বেঁচে ফেরেনও তাঁরা, তাহলেও কিছুদিনের মধ্যেই অপমৃত্যুর শিকার হতে হয় তাঁদের।
না, কোনো সিনেমা নয়। কথা হচ্ছে হন্ডুরাসের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন শহরকে নিয়ে। অনেকের কাছে শ্বেতপাথর নির্মিত এই শহরের পরিচয় ‘হোয়াইট সিটি’। আবার কেউ কেউ এই শহরকে চেনেন ‘সিটি অফ মাংকি গড’ বা ‘বানর দেবতার শহর’ নামে। হ্যাঁ, নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই শহরের রহস্য। অর্ধমানব ও অর্ধবানররূপী ডেমিগডদের অভিশাপেই নাকি জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল এই নগরী। ধীরে ধীরে এই শহরও তলিয়ে যায় অরণ্যের মাঝে। প্রশ্ন থেকে যায়, কস্মিনকালে আদৌ কি এমন কোনো নগরী ছিল হন্ডুরাসের বুকে? নাকি পুরোটাই মিথ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে ৫০০ বছর। ১৫২০ সাল। মেক্সিকো জয় করেন স্প্যানিশ হার্নান কর্টেজ। অ্যাজটেক সভ্যতার পতনের নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, অ্যাজটেকদের থেকে শ্বেতপাথরে নির্মিত এক আশ্চর্য শহরের কথা জানতে পেরেছিলেন তিনি। সেখানে নাকি ছড়িয়ে রয়েছে সোনা, রুপো, রত্নের বিপুল সম্ভার। এই শহরটিকেও স্প্যানিশ রাজ কাস্তিলের অধীনে আনতে বর্তমানে হন্ডুরাসে পাড়ি দিয়েছিলেন হার্নান কর্টেজ। তবে অরণ্যের মাঝে এই শহর খুঁজে পাননি তিনি।
পরবর্তীতে স্প্যানিশদের হাত ধরেই এই অদ্ভুত শহরের কথা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। স্পেন তো বটেই, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল থেকেও বহু অভিযাত্রী এই শহরের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন হন্ডুরাসে। অধিকাংশকেই ফিরে আসতে হয়েছিল হতাশ হয়ে। বাকিরা নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন এই অরণ্যেই। ১৯৪০ সালে সর্বপ্রথম সাফল্য পান থিওডোর মর্ড নামের এক পর্যটক।
হ্যাঁ, অন্তত তেমনটাই দাবি করেছিলেন তিনি। হন্ডুরাসের মসকুইটিয়ার ঘন অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত এই শহর, জানিয়েছিলেন মর্ড। তৎকালীন মার্কিন ‘আমেরিকান উইকলি’-তে তা নিয়ে প্রকাশিতও হয়েছিল তাঁর লেখা একটি বিশেষ প্রবন্ধ। শ্বেতশহরের সিটাডেল অর্থাৎ প্রধান দুর্গ ছাড়াও একাধিক নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি। মর্ডের মতে, এই শহরের বাসিন্দারা ছিলেন ‘মায়া’ সভ্যতার মানুষদের পূর্বপুরুষ। তাঁদেরকে চোরোটেগাস নামে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, চোরোটেগাসরা ছিলেন একেশ্বরবাদী, বানর দেবতার উপাসক। এমনকি মর্ড এও লিখেছিলেন, এই প্রাচীন দেবতার সঙ্গে মিল রয়েছে ভারতের হিন্দু সংস্কৃতি ও পবনপুত্র ‘হনুমান’-এর। মর্ডের এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পরেই ‘সিটি অফ মাংকি গড’ নামে পরিচিত পায় হন্ডুরাসের এই রহস্যময় শহর।
মর্ড এই শহর খুঁজে পেয়েছিলেন, তর্কের খাতিরেই তা নয় বিশ্বাস করে নেওয়া গেল। কিন্তু প্রাচীন এইসকল সংস্কৃতির সম্পর্কে কীভাবে জানলেন তিনি? আসলে এই শহরে অনুসন্ধান চালানোর সময়, স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকেছেন মর্ড। তাঁদের থেকেই তিনি জেনেছিলেন প্রাচীন সংস্কৃতির ব্যাপারে। এমনকি মর্ডের লেখায় ‘ডান্স অফ দ্য ডেড মাংকিস’ নামের এক অদ্ভুত উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। বানর দেবতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি করে থাকেন সেখানকার স্থানীয়রা। বানর ধরে জীবিত অবস্থায় তাদের পুড়িয়ে মারাই এই উৎসবের রীতি। যা আজও অল্পবিস্তর প্রচলিত হন্ডুরাসে। ফলে, মর্ডের দাবি যে সম্পূর্ণ ভাঁওতা— এমনটা নয়।
পঞ্চাশের দশকে এই প্রাচীন শহরের ধ্বংসস্তূপ উদ্ধারের জন্য মার্কিন সরকারের কাছে অর্থ ও প্রত্নতাত্ত্বিক সাহায্যের আর্জি জানান মর্ড। তবে দীর্ঘদিন তাঁর এই আবেদনে সাড়া দেয়নি মার্কিন প্রশাসন। এই প্রকল্পের জন্য সামান্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল ঠিকই, তবে তাতে কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে। এর বছর খানেকের মধ্যেই ১৯৫৪ সালে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় মর্ডের। ম্যাসাচুসেটে অবস্থিত পৈত্রিক বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল স্নানঘর থেকে।
অনেকের মতে, বানর দেবতার অভিশাপেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। আবার অনেকে তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসাবে দেখতে নারাজ আজও। দাবি, খোদ মার্কিন সরকারই এই প্লট সাজিয়েছিল তাঁকে সরিয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু কোন সত্য গোপন করতে এমন পদক্ষেপ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন? তা আজও রহস্যে মোড়া। আর ‘হোয়াইট সিটি’?
আজ থেকে ৭ বছর আগের কথা। ২০১৫ সালে ‘স্পেশাল এয়ার ফোর্স’-এর প্রাক্তন সেনা ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল পাড়ি দিয়েছিলেন মসকুইটিয়ার অরণ্যে। মর্ডের চিহ্নিত করা অঞ্চলে তাঁরা খুঁজে পান খান পঞ্চাশেক পাথরের তৈরি আসবাবপত্র ও মূর্তি। সেইসঙ্গে পাথরের তৈরি প্রাচীরের কিয়দাংশও নজর কেড়েছিল তাঁদের। কার্বন ডেটিং বলছে সেগুলির বয়স ছশো থেকে হাজার বছর। অর্থাৎ, আনুমানিক ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে ইতি পড়েছিল এই সভ্যতার। তবে এইসব প্রত্নসামগ্রী আদৌ ‘সিটি অফ মাংকি গড’-এর কিনা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এমনকি ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’ পত্রিকায় সে-সময় ফলাও করে এই সংবাদ ছাপা হলেও গোপন রাখা হয় প্রত্নক্ষেত্রের অবস্থান। সবমিলিয়ে পাঁচশো বছর পেরিয়েও আজও রহস্যের মেঘ সরেনি হন্ডুরাসের এই প্রাচীন শহরের আকাশ থেকে…
Powered by Froala Editor