সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ডেলটা অঞ্চল। গাঙ্গেয় উপত্যকার একেবারে দক্ষিণে ভাগীরথী ও পদ্মা সমুদ্রে মেশার সময় জন্ম নিয়েছে বহু বহু শাখা নদী। তৈরি হয়েছে কয়েকশো দ্বীপ। তবে এই দ্বীপমালার মধ্যে যদি হঠাৎ করে নতুন দ্বীপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে? হ্যাঁ, বাস্তবে এমনটাই হয়েছিল সত্তরের দশকে। ১৯৭০ সাল সেটা। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ভোলা আঘাত হেনেছিল দুই বঙ্গেই। তছনছ করে দিয়েছিল দুই বাংলাকে। প্রাণ নিয়েছিল ৩ লাখ মানুষের। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল এক অপার্থিব দৃশ্য। সুন্দরবনের (Sundarbans Delta) ডেলটায় মাথা তুলে জেগে উঠেছিল এক নতুন দ্বীপ (Island)।
স্বাভাবিকভাবেই এক ঝাঁক প্রশ্ন ভিড় করার কথা মাথার মধ্যে। কোথায় এই দ্বীপ? এই দ্বীপের নামই বা কী? প্রাথমিকভাবে সাতক্ষীরা উপকূলের কাছে হাঁড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার নিকটে অবস্থিত এই দ্বীপ নজরে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে আমেরিকার উপগ্রহ ইআরটিএস-১ আনুষ্ঠানিকভাবে শনাক্ত করে দ্বীপটিকে। ভারত ও বাংলাদেশ— দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে দুটি ভিন্ন নামে পরিচয় পায় এই দ্বীপ। ভারত এই দ্বীপের নাম রেখেছিল ‘নিউ মুর’ আইল্যান্ড (New Moore Island)। অন্যদিকে বাংলাদেশে এই দ্বীপের পরিচয় ‘পূর্বাশা’ বা ‘দক্ষিণ তালপট্টি’।
কিন্তু একই দ্বীপের দুটি ভিন্ন নাম? একটু অবাক হওয়ারই বিষয়। আসলে দুই দেশই এই ছোট্ট দ্বীপটিকে তাদের দেশের অংশ বলে দাবি জানিয়েছিল। সেখান থেকেই সূত্রপাত বিতর্কের। ভিন্ন নামকরণের কারণও সেটাই। নিউ মুর আইল্যান্ড বা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে তারপর বিতর্ক চলেছে আরও চার দশক ধরে। এমনকি ভারত-বাংলাদেশ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও এই দ্বীপকে কেন্দ্র করে সামরিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল দুই দেশ। ১৯৮১ সালে এই দ্বীপে আইএনএস সন্দক জাহাজ প্রেরণ করেছিল ভারতীয় নৌসেনা। ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশও দুটি গানবোট পাঠায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়নি, ভারত সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল দ্বীপটি থেকে। পরবর্তীতে কূটনৈতিক আলোচনায় তা ঘোষণা করা হয় নো ম্যানস ল্যান্ড হিসাবে। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি বিতর্ক। এই দ্বীপের অধিকার আদায়ের জন্য দুই দেশই দ্বারস্থ হয়েছিল আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের। শেষ পর্যন্ত কী রায় দিয়েছিল সেই আদালত?
না, স্পষ্টভাবে কোনো রায় দিতে পারেনি আদালত। কারণ যেমন রহস্যময় ছিল তার উত্থান, তেমনই অদ্ভুতভাবেই বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে হারিয়ে যায় নিউ মুর আইল্যান্ড। সেটা ১৯৮৫ সালে আরও একটি ঘূর্ণিঝড়ের পর জলের তলায় চলে গিয়েছিল ২.৫ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট দ্বীপটি। তবে তখনও পর্যন্ত সমুদ্রতলের অগভীরেই ছিল এই দ্বীপ। তারপর একটু একটু তার কফিনে পেরেক বসিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। ক্রমশ সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিরতরেই হারিয়ে গেছে নিউ মুর আইল্যান্ড।
আরও পড়ুন
৩ লক্ষ ইঁদুরের দৌরাত্ম্য, বেহাল হতে বসেছিল এই দ্বীপ!
বিচারের সময় ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে এসে তাই খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল হেগস-এর সালিসি আদালতের বিচারকদের। অন্যদিকে ১৯৮৯ সাল থেকে আমেরিকার স্যাটালাইটেও আর ধরা পড়ে না দ্বীপটির অস্তিত্ব। ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত ঘোষণা করে, ‘নো মোর নিউ মুর’। যদিও দ্বীপের অস্তিত্ব না থাকলেও, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সমুদ্রকে ভারতের সীমানাধীন বলেই রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত।
আরও পড়ুন
সামুদ্রিক খননে বাড়ছে পরিবেশদূষণ, জাতিসংঘের দরবারে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র
তবে পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও রহস্যেই মুড়ে রয়েছে এই বিচিত্র দ্বীপের কাহিনি। কিন্তু ছোট্ট এই দ্বীপের কারণে কেন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত-বাংলাদেশ। গবেষকদের মতে, দ্বীপটির পেটের ভেতর লুকিয়ে ছিল খনিজ তেল, আকরিক-সহ নানান খনিজের রত্নভাণ্ডার। ফলে, অর্থনৈতিক দিক থেকে দুই দেশেরই ভাগ্য পাল্টে দিতে পারত নিউ মুর। পাশাপাশি এই দ্বীপকে সামরিক ঘাঁটি করে বঙ্গোপসাগরে শক্তি বৃদ্ধি করতে পারত তারা। শেষ পর্যন্ত দুই দেশেরই স্বপ্নভঙ্গ করে অন্তর্ধান নেন ‘মিস্টার মুর’…
আরও পড়ুন
‘রিয়েল এস্টেট’ দ্বীপে সংরক্ষিত অরণ্য কানাডার বৃদ্ধের
Powered by Froala Editor