১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি। ভারতের স্বাধীনতার প্রায় ১৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। একটু একটু করে নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করছে দেশটি। নতুন দেশ, তার নতুন আশা, অনন্ত সম্ভাবনা। বিশ্বের মঞ্চে নিজের পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা। সেই আশা নিয়েই আকাশে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১০১, বোয়িং ৭০৭। মুম্বই থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন ১০৬ জন যাত্রী। সঙ্গে ছিলেন ১১ জন বিমানকর্মী। দিব্যি চলছিল প্লেনটি। দেখতে দেখতে মঁ ব্লাঁ’র ওপরে পৌঁছে গেল এটি। আর মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরই লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের মাটি ছোঁবে সবাই। হঠাৎই যেন কেঁপে উঠল প্লেনটি। তারপর? বাকিটা অন্ধকার। পরের কাহিনির শুরুতেই দেখা যায়, মঁ ব্লাঁ’র ওপর ভেঙে পড়ে আছে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১০১ বোয়িং ৭০৭। ভেতরে কিছুই আর আস্ত নেই। ভারতে পৌঁছে গেল সেই খবর। গোটা দেশ এক লহমায় আবারও কেঁপে উঠল। কারণ, ওই ১০৬ জন যাত্রীর মধ্যেই ছিলেন ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানের জনক…
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থানে আছে ভারত। শুধু কি অস্ত্র? পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশের ভেতর আর কোন আশ্চর্য লুকিয়ে আছে, আরও কী কী ভাবে তাকে কাজে লাগানো যায়— তা নিয়ে প্রতিদিন চলছে গবেষণা। এই বৃহৎ চালচিত্রটি তৈরিই হত না, যদি বিজ্ঞানী হোমি ভাবা না থাকতেন। জন্মেছিলেন এক বিত্তশালী পার্সি পরিবারে, স্বয়ং দোরাবজি টাটাও ছিলেন তাঁদের ঘনিষ্ঠ। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিস ছিল। মেধা— যাকে ভর করে বাকি জীবনটা পেরিয়ে যাবেন তিনি। এই দেশের মাটিকে যেমন ভালোবেসেছিলেন, তেমনই চেয়েছিলেন একদিন গোটা বিশ্বে বিজ্ঞানের জগতে ভারত শ্রেষ্ঠ স্থানটি পাবে।
পড়তে পড়তে চলে গেলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। পা পড়ল ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে। একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের কেন্দ্রভূমি ছিল এই ল্যাব। এখানে দাঁড়িয়েই জেমস চ্যাডউইক প্রথমবার আবিষ্কার করেছিলেন নিউট্রন কণা। সেখানে দাঁড়িয়েই পরমাণু ও নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে গবেষণায় মেতে উঠলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। উত্তরণের রাস্তাটা একটু একটু করে যেন সামনে আসতে লাগল। ইতিমধ্যেই ভারতের ওপর থেকে নেমে গেছে ইউনিয়ন জ্যাক। নতুন সূর্যের আলো এসে পড়েছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার ওপর। হোমি ভাবাও ১৯৪৭-এর বহু আগেই ফিরে এসেছেন ভারতে। শুরু হল ভারতের নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণার এক নতুন ও অনন্য অধ্যায়। যে রথের প্রধান সারথি ছিলেন স্বয়ং বিজ্ঞানী ভাবা! একের পর এক আধুনিক গবেষণাকেন্দ্র তৈরি হল দেশে। আর তার হাত ধরেই নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্নটাও জাঁকিয়ে বসছিল আমাদের মধ্যে…
পরমাণু নিজে ক্ষুদ্রতম হলেও, বিষয়টি মোটেও ছোটো নয়। পরমাণু নিয়ে গবেষণা করা মানে এক বিরাট দায়িত্ব। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাত ধরে মানুষ দেখে ফেলেছে পরমাণু বোমার শক্তি। আমেরিকার ক্ষমতাও সবার সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিজ্ঞানের মানচিত্রে উঠে এলেন সদ্য স্বাহিন হওয়া দেশের এক বিজ্ঞানী। ইতিমধ্যেই বিশ্ব থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন হোমি ভাবা। রয়্যাল সোসাইটির ফেলোও হয়েছেন। পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্যও বেশ কয়েকবার বিবেচিত হয়েছে তাঁর নাম। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তাঁর হাতে উঠে আসেনি সেই সম্মান। কেন? জানা নেই। অবশ্য তাতে কি কিছু যায় আসে ডঃ ভাবা-র! তিনি নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছেন…
ঠিকঠাকই চলছিল সবটা। হঠাৎই যেন দাঁড়ি পড়ে গেল সেই স্রোতে। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে অকালেই শেষ হল একটা অধ্যায়ের। বিমান দুর্ঘটনায় চলে গেলেন ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি যেভাবে ভেঙে পড়েছিল পাহাড়ের ওপর, তাতে কারোরই যে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল না তা বোঝাই গিয়েছিল। তাও শেষ আশা, যদি ডঃ ভাবা বেঁচে যান। না, লাখ লাখ মানুষের প্রার্থনা বিফলে গিয়েছিল। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠা করা ট্রম্বে’র অ্যাটমিক এনার্জি এস্টাব্লিশমেন্টের নাম বদলে রাখা হয় ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার। আজও যা নিউক্লিয় গবেষণার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে…
না, এখানেই থেমে যায়নি গল্পটা। বরং রহস্যের সূত্রপাত এরপরেই। সত্যিই কি বিমান ‘দুর্ঘটনায়’ মারা গিয়েছিলেন ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা? নাকি এটা পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিল? দুর্ঘটনার চেহারার আড়ালে কি জড়িয়ে রয়েছে কোনো জটিল তত্ত্ব? ১৯৬৬ সালে হোমি জাহাঙ্গির ভাবা-র মৃত্যুর পরই সামনে আসতে থাকে প্রশ্নগুলো। ভারতের এহেন উত্থানে কি শিয়রে সমন দেখেছিলেন আরও কেউ? ব্যস, এই সন্দেহ থেকেই শুরু হয় তদন্ত।
বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন তদন্তকাজে হাত বাড়িয়েছেন। যে মানুষটা এতবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন, সোভিয়েত রাশিয়ার বাইরে এশিয়ার প্রথম পারমাণবিক রিয়েক্টর তৈরি করেছিলেন, টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মতো একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন— তাঁর এমন মৃত্যু কেউই মানতে পারছিলেন না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তদন্ত যত এগোতে থাকে, ততই সন্দেহ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। দুর্ঘটনা নয়, সম্ভবত চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। পরিকল্পিতভাবেই বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটানো হয়। আর এই যাবতীয় চালচিত্রে উঠে আসে আরও একটি দেশ— আমেরিকা…
তদন্ত যত এগোতে থাকে, ততই জোরালো হতে থাকে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ-র ভূমিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী আবারও দেখল এক নতুন লড়াই— ঠান্ডা যুদ্ধ। বিশ্বে তখন দুটি প্রধান শক্তি, আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া। সরাসরি রণাঙ্গনে নামল না কেউ, অথচ ভেতরে ভেতরে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে লাগল। আর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক ছিল। সদ্য ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশটি, আর সেখান থেকেই উঠে এলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা-র মতো একজন বিজ্ঞানী! যিনি একটি দেশের পারমাণবিক মেরুদণ্ডটিকে শক্ত করছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালেই অল ইন্ডিয়া রেডিও’র অনুষ্ঠানে ভাবা বলেছিলেন, ভারত এখন পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলার মুখে দাঁড়িয়ে। শুধু সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষা। আর তার কয়েকমাস পরেই, ১৯৬৬-এর জানুয়ারিতে চিরতরে হারিয়ে গেলেন তিনি। কাকতালীয়?
এমন সময় ২০০৮ সালে চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য বিশ্বের সামনে উঠে আসে। তথ্য বলতে একটি ফোনকল। যার একদিকে ছিলেন সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাস, অন্যদিকে ছিলেন সিআইএ’র অফিসার ও গোয়েন্দা রবার্ট ক্রাউলি। ষাটের দশকে তিনি গোয়েন্দা সংস্থার অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন। সেই ফোনালাপেই পরমাণু বোমার মতোই বিস্ফোরণ ঘটান ক্রাউলি। যেখানে তিনি একপ্রকার স্বীকার করেই নিয়েছিলেন, এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১০১-এর ভেঙে পড়া কোনো দুর্ঘটনা নয়; পরিকল্পিতভাবেই সেটি ঘটানো হয়েছিল একটি বোমার সাহায্যে। এবং এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় এটি দুর্ঘটনা…
কিন্তু সিআইএ কেন এমন কাজ করেছিল? কারণ একজনই— ডঃ হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। পরমাণু বোমার এত কাছে যখন পৌঁছে গেছে মানুষটি, তখন তো আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যও প্রশ্নের মুখে পড়বে। তার ওপর ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বেশ ভালো। সব দিক দেখেই নাকি ঠিক হয়েছিল, এই কাজটি এখানেই থামিয়ে দেওয়া হোক। মাথা চলে গেলেই হয়তো থেমে যাবে সমস্ত কাজ। তাই, সেই ‘মাথা’কেই টার্গেট করে এগোনো হল। যার ফল, ১৯৬৬-এর বিমান ‘বিস্ফোরণ’…
এই ঘটনা কি আদৌ সত্যি? জানা নেই। প্রথমে বলা হয়েছিল, জেনেভা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে বিমানের চালকের ভুল বোঝাবুঝি হয়। তাতেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। আদৌ কি তাই? প্রশ্ন তুলেছেন ড্যানিয়েল রোশ। বহু বছর ধরে এই ব্যাপারে গবেষণা করছেন এই অভিযাত্রী। পৌঁছে গিয়েছিলেন অকুস্থলে। সেখানে ওই বিমানের সঙ্গে একটি আমেরিকান যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষও নাকি পেয়েছেন তিনি! ওই বিমানটি কোথা থেকে এল? তাহলে কি পুরো ঘটনাতেই জড়িয়ে আছে আমেরিকা? এখনও চলছে গবেষণা। চলছে অনুসন্ধান। রাজনৈতিক চাপানউতোরের আড়াল থেকে যেন বেরিয়ে আসেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, বেরিয়ে আসে তাঁর বিচার— এমনটাই আশা সবার। যিনি আমাদের আশা দেখিয়েছিলেন, তিনি বরফের ওই ঠান্ডায়, ছাই হয়ে পড়ে থাকতে পারেন না! ফিনিক্স তাঁকে হতেই হবে…
তথ্যসূত্র—
১) ‘বিমান দুর্ঘটনা, নাকি চক্রান্তে মৃত্যু হোমি ভাবার’, পীযূষ আশ, এই সময়
২) ‘আল্পসে হোমি ভাবার বিমান ভেঙে পড়েছিল সিআইএ’র ষড়যন্ত্রে?’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘হোমি জাহাঙ্গির ভাবা— পরমাণু শক্তির কারিগর’, প্রদীপ দেব, মুক্তমনা ব্লগ
৪) ‘Sabotage or accident? The theories about how India lost nuclear energy pioneer Homi Bhabha’, Neera Majumdar, The Print
Powered by Froala Editor