রাতের অন্ধকারকে তো ভয় পায় অনেক শিশুই। কিন্তু পাকিস্তানের দুই বালকের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সারাদিন দুরন্ত, চনমনে। অথচ সূর্যের আলো ফুরোলেই নিস্তেজ হয়ে আসে সারা শরীর। মৃত্যু যেন ছুঁয়ে যায় তাদের। পরদিন সকালে আবার পুরোপুরি ‘সুস্থ’ দুজন। না, কোনো রূপকথা বা পুরাণের গল্প নয়। অনেকটা এরকমই জীবন ছিল পাকিস্তানের ‘সোলার কিড’-দের (Solar Kids)।
পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমের বালুচিস্থান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটা (Quetta)। পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর শহরটিকে অনেকে বলে ‘মিনি প্যারিস’। জনপ্রিয়তা আছে ফলের বাগানের জন্য। সেখান থেকে মিয়ানকুন্ডি (Miankundi) গ্রামের দূরত্ব খুব বেশি নয়। শোয়েব আহমেদ আর আবদুল রশিদের বাড়ি সেই গ্রামে। আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে দুই ভাইয়ের জীবন ছিল একটু আলাদা। প্রতিদিন প্রার্থনা করত যেন সূর্যাস্ত না হয়। কারণ, সূর্যদেব পশ্চিম দিকে হেলে পড়লেই সারা শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে যেত তাদের। হাঁটাচলা তো দূরের কথা, থাকত না সামান্য কথা বলা বা খাওয়ার শক্তি পর্যন্ত। ২০১৬ সালে প্রথমে নজরে আসে তাদের এই সমস্যার কথা। তখন তাদের বয়স যথাক্রমে তেরো আর নয়।
পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যে সে অর্থে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু জন্মের দু বছরের মাথাতেই শোয়েবের মধ্যে দেখা দেয় সমস্যার মূল লক্ষণগুলি। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে মেলেনি কোনো সমাধান। ক্রমে একই পরিস্থিতি হয় আবদুলেরও। তাদের বাবা মোহম্মদ হাশিম স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী। যৎসামান্য আয়। ফলে ছিল না শহরের বড়ো কোনো জায়গায় চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে তার দুই ছেলে। কিছুটা সেভাবেই ‘খ্যাতি’ বাড়তে থাকে দুজনের।
দ্রুত তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে ইসলামাবাদ পর্যন্ত। প্রচারমাধ্যমে ‘সোলার কিড’ বলে পরিচিতি লাভ করে তারা। যদিও পাকিস্তানের ‘ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স’-এর অধ্যাপক জাভেদ আক্রম প্রথমেই নাকচ করে দিয়েছিলেন সূর্যের আলোর থেকে সরাসরি শক্তি সংগ্রহের ব্যাপারটি। দেখা গেছে মেঘাচ্ছন্ন দিনে কিংবা অন্ধকার ঘরেও দিব্যি চলাফেরা করত তারা। কিন্তু আসল সমস্যাটি ধরতে পারেননি তিনিও। ফলে পুরো বিষয়টিকে একটা ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেই দেখেছিলেন চিকিৎসকরা। সরকার থেকেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল সমস্ত ব্যয়ভার বহনের।
আরও পড়ুন
সূর্য উঠলেই মৃত্যু! অন্ধকারেই বেড়ে ওঠে এই অর্কিড
১৩ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করত তাদের। পাশাপাশি বাইরের ১৩টি দেশে পাঠানো হয়েছিল মিয়ানকুন্ডির জল ও মাটি। কিন্তু মেলেনি আসল উত্তরটি। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি পাকিস্তানের ডাক্তাররা আগে কখনও হননি। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়েছিল যে, নিউরো ট্রান্সমিটারে কোনো সমস্যার কারণেই এই পরিস্থিতি। তা সত্ত্বেও আবিষ্কার করা যায়নি সূর্যের আলোর সঙ্গে সম্পর্ক। দিনের বেলা দুই ভাইয়ের প্রাণচঞ্চল আচরণ দেখে কেউ বুঝতেও পারবে না, কী সমস্যা লুকিয়ে আছে রাতের আঁধারে।
আরও পড়ুন
সূর্য থেকেই ‘জন্ম’ জলের! কীভাবে?
ডাক্তাররা আশাবাদী ছিলেন যে, কোনো সমাধান অবশ্যই বেরোবে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে ইসলামাবাদের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে। পরের দিকে সুস্থ হয়ে ওঠে তারা। ধীরগতিতে হলেও রাতের ‘ভয়’-কে কাটিয়ে শুরু করে হাঁটাচলা। শোয়েবের স্বপ্ন ছিল, সে বড়ো হয়ে শিক্ষক হবে। আর আবদুল চেয়েছিল ধর্মশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে। আশা করা যায়, তারা সেই স্বপ্নপূরণের দিকে অনেকটাই পথ হেঁটে গেছে। রাত যত গভীর হবে, ততই তো কাছে আসে দিনের আলো।
Powered by Froala Editor