স্কুলজীবন থেকেই যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। অভিনয় ছিল তাঁর সহজাত ক্ষমতা। চার্লি চ্যাপলিনের হুবহু নকল করে মুগ্ধ করে রাখতেন বান্ধবীদের। তার সেই কারণেই জুটেছিল ‘চার্লস’ ডাকনাম। কিন্তু তখন কে-ই বা জানত, একদিন এই নামের ওপরেই গড়ে উঠবে কুখ্যাতির পাহাড়? গুরমুখ ভাবনানি শোভরাজ, ওরফে চার্লস শোভরাজ। তাঁকে নিয়েই এবার প্রকাশিত হল বিবিসি’র সিরিজ ‘দ্য সারপেন্ট’। আর তা নিয়েই উত্তাল গোটা পৃথিবী।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় হবে সেটা। ১৯৭৫ সাল। আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল থাইল্যান্ড। স্রেফ বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছিল পাশ্চাত্য থেকে আসা একের পর এক পর্যটক। বিশেষত মহিলারাই। কিছুদিন পর সমুদ্রের ধার থেকে উদ্ধার হত তাঁদের ঝলসে যাওয়া দেহ। পরনে বিকিনি। সমস্ত অর্থ, মূল্যবান অলঙ্কারের সঙ্গে ‘মিসিং’-লিস্টে থাকত তাঁদের পাসপোর্ট। প্রতি ক্ষেত্রেই সাদৃশ্য থাকত ফরেন্সিক রিপোর্টে। প্রথমে মাদক প্রয়োগ, তারপর জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা। খুনের এমন অদ্ভুত ধরণের জন্যই ঘাতক পরিচিত হন ‘বিকিনি কিলার’ নামে। কিন্তু এই মুখোশের আড়ালে কে লুকিয়ে রয়েছে, তার সন্ধান মেলেনি তখনও।
বছর খানেক বাদে একইভাবে তাঁর শিকার হলেন থাইল্যান্ডে ঘুরতে আসা এক ওলন্দাজ দম্পতি। উঠেছিলেন হল্যান্ডেরই দূতাবাসে। কাজেই নড়েচড়ে বসল প্রশাসন। তদন্তের দায়িত্ব নিলেন ওলন্দাজ কূটনীতিবিদ হার্মান ক্লিপেনবার্গ। অবশেষে জানা গেল ঘাতকের পরিচয়। চার্লস শোভরাজ। শুধু সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বছর দুয়েকের মধ্যেই চল্লিশের বেশি খুন করেছেন তিনি থাইল্যান্ডে। তবে তাঁর শিকারের মানচিত্র শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারত, নেপাল, ফ্রান্স, গ্রিস, আফগানিস্তান-সহ একাধিক দেশেই অপরাধের জাল বুনেছেন তিনি।
চার্লস শোভরাজের এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। তবে যেটা লক্ষ্যণীয় বিষয়, তা হল তাঁর খুনের মোটিভ। যা আর পাঁচটা সিরিয়াল কিলারের থেকে আলাদা করে দিয়েছে শোভরাজকে। সাধারণত সিরিয়াল কিলারদের করা ধারাবাহিক খুনের পিছনে থাকে কোনো গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ। চার্লসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একাবারেই তেমন ছিল না। বরং, অর্থ-প্রতিপত্তি-মূল্যবান রত্নের জন্যই বারবার রক্তে হাত ধুয়েছেন তিনি। আর পাসপোর্ট চুরি? তা নিছকই নকল করে এক দেশ থেকে অন্যত্র পালানোর জন্য।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই কি একের পর এক ধারাবাহিক খুনের পিছনে কোনো মনস্তত্ত্ব ছিল না তাঁর? হ্যাঁ, ছিল। শোভরাজের প্রাথমিক হাতিয়ারই ছিল শিকারের ওপর মানসিক প্রভাব বিস্তার। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। শিকারদের কিন্তু জোর করে অপহরণ করতেন না তিনি। বরং, নিজের ইচ্ছাতেই তাঁরা শোভরাজের সঙ্গে সামিল হতেন। তারপরই ঘটত হত্যালীলা। তাই খুনির থেকেও ‘ম্যানিপুলেটার’ কথাটাই হয়তো বেশি প্রযোজ্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই সিরিয়াল কিলারের জন্য।
শোভরাজের ব্যক্তিগত জীবনেও স্পষ্ট এই ব্যাপারটা। মহিলাদের মুগ্ধ করায় ছোটো থেকেই যে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি, তা বলা হয়েছে শুরুতেই। শোভরাজের এই ক্যারিশ্মারই শিকার ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী শানতাল। রক্ষণশীল অভিজাত ফরাসি পরিবারের কন্যা তিনি। প্রথম ভালোবাসা, তারপর দেশ ছেড়ে পলায়ন। কিন্তু শোভরাজের সংস্পর্শ হুবহু পাল্টে দিল শানতালের চরিত্র। শুরুতে যে শানতাল আতঙ্কিত থাকতেন প্রেমিকের এই অন্ধকার জগত নিয়ে, সেই শানতালই একটা সময় হয়ে উঠলেন অন্যতম তাঁর সহকর্মী।
এবার সত্তরের দশক থেকে ফিরে আসা যাক এই শতকের প্রথম দশকে। ২০০৮ সাল। নেপালে কারাবন্দি শোভরাজ। আর জেলে থেকেই দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন তিনি ৪৩ বছরের ছোটো নিহিতা বিশ্বাসকে। বাবা বাঙালি হলেও, নিহিতা নেপালের নাগরিক। নিহিতা তখন আইনের ছাত্রী। শোভরাজের আইনজীবীর হয়ে দোভাষীর কাজ করতেই তিনি হাজির হয়েছিলেন কারাগারে। প্রথম দেখাতেই প্রেম। তার কয়েক মাসের মধ্যেই বিবাহ। তবে শোভরাজের সঙ্গে পরিচয়ের পরে তাঁর মধ্যেও দেখা গিয়েছিল এক অদ্ভুত বদল। খুনের সমস্ত তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নিহিতা দাবি করেছিল, সম্পূর্ণ নিষ্পাপ শোভরাজ। কারাবন্দি চার্লসের সঙ্গে দেখা করতে প্রায়শই তিনি হাজির হতেন কারাগারে। পৌঁছে দিতেন বিলাসবহুল পানীয়। জেল থেকে মুক্তির পর নতুন সংসার গড়ার পরিকল্পনার কথা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন শোভরাজ। তবে সেটাই কি তাই? নাকি স্রেফ কারাবন্দি অবস্থায় কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্যই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি নিহিতার ওপরে। এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।
প্রথম জীবনে ফ্রান্সে অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়ার পর শোভরাজ বিস্তারে পড়াশোনা করেছিলেন মনস্তত্ত্ব এবং আইন নিয়ে। সেই শিক্ষা যে ছত্রে ছত্রে কাজে লাগিয়েছেন তিনি, তাতে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র। অপরাধ জগতে খুনের পাশাপাশি শোভরাজের খ্যাতি কারাগার ভাঙার দক্ষতার জন্যেও। ভারতের দুর্ভেদ্যতম কারাগার তিহার জেল থেকে পলায়নই হোক কিংবা বন্দি অবস্থায় দিল্লির হাসপাতাল থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা— প্রতিক্ষেত্রেই রয়েছে সেই মনস্তাত্ত্বিক ছক। গারদ ভাঙার আগে, তিহারের সমস্ত কয়েদি এবং জেলারদের নিয়ে দু’বার পিকনিকের আয়োজন করেছিলেন তিনি। তারপর তৃতীয় পিকনিকে মাদক মেশানো হল কাস্টার্ডে। প্রথম দুটি ঘটনা শুধু পুলিশ প্রশাসনের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সাজানো দাবার চাল।
তিহার থেকে পালানোর পর শোভরাজ আবার ধরা পড়েন। তবে তাতে পুলিশের কৃতিত্ব কতটা ছিল, সন্দেহ আছে সে বিষয়ে। কৌশল করেই ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি ধরা দিয়েছিলেন— সেই সম্ভাবনাই প্রকট। তা যদি না-ই হয়, তবে প্রকাশ্যে ট্যাক্সি থেকে নেমে বিলাসবহুল হোটেলে কেন ডিনার করতে যাবেন তিনি? যখন কিনা তাঁর নামে সারা দেশে জারি রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ছত্রে ছত্রে জাল বিছিয়ে রেখেছে পুলিশ।
একটু ভেবে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে বিষয়টা। আসলে শোভরাজের প্রয়োজন ছিল খানিকটা সময় কিনে নেওয়ার। কেননা ১৯৯৫ সালে থাইল্যান্ড মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল শোভরাজকে। সে দেশে পৌঁছলে এক প্রকার নিশ্চিত ছিল মৃত্যু। তবে থাইল্যান্ডের আইন বলছে, রায়ের সর্বোচ্চ মেয়াদ ২০ বছর। তার মধ্যে যদি অপরাধী ধরা না পড়ে, তবে বাতিল হবে সেই আদেশ। ফলত, ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি ধরা দেন ভারতীয় পুলিশের কাছে। অর্থাৎ, শাস্তির তুল্যমূল্য বিচার করেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন কারাগারকে। এও তো গভীর মনস্তত্ত্ব!
বর্তমানে নেপালে কারাবন্দি শোভরাজ। বিগত ১৬ বছর ধরেই তিনি রয়েছেন সেখানে। তবে এর মধ্যে একবারও গারদ ভাঙার চেষ্টা করেননি তিনি। ২০০৪ সালে ফ্রান্সের গোপন ডেরা থেকে কেনই বা এসে তিনি ধরা দিয়েছিলেন নেপালে, সঠিক কারণ জানা নেই তারও। হতে পারে এও তাঁর কোনো মাস্টার-স্ট্রোক। আজ থেকে কয়েক বছর পর হয়তো জানা যাবে সেই কারণ। অথবা, প্রকাশ্যে আসবে না কোনোদিনই…
Powered by Froala Editor