১৯৯৯ সালে ‘শেষ’ অনুষ্ঠান, সেখান থেকেই নতুন যাত্রা কালিকাপ্রসাদের

৭ আগস্ট, ১৯৯৯। কলকাতার স্টুডেন্ট হলে আত্মপ্রকাশ এক নতুন ব্যান্ডের। বাংলা লোকগানের এক অদ্ভুত সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছেন শিল্পীরা। তবে মঞ্চে উঠে প্রথমেই তাঁরা জানিয়ে দিলেন, এই তাঁদের প্রথম এবং শেষ অনুষ্ঠান। একটার পর একটা গান শুরু হল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন সমবেত শ্রোতারা। অনেক লোকগান তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু এই দলের পরিবেশন যেন সম্পূর্ণ আলাদা। এই অনুষ্ঠান কী করে শেষ অনুষ্ঠান হয়? আরও অনেক গান গাওয়া বাকি।

হ্যাঁ, সেই শেষ থেকেই শুরু হয়েছিল ‘দোহার’-এর (Dohar) পথচলা। দোহার এবং কালিকাপ্রসাদ (Kalikaprasad)। দেখতে দেখতে বিখ্যাত হয়ে উঠল দলটি। তবে বিখ্যাত হওয়ার জন্য তাঁরা সঙ্গীতের মঞ্চে আসেননি। এসেছিলেন একটা ছোট্ট ইচ্ছা থেকে। কালিকাপ্রসাদের ছোটোকাকা অনন্ত ভট্টাচার্য, তাঁর অন্তুকাকা, তাঁরও ছিল একটি গানের দল। ‘লোকবিচিত্রা’। শিলচর শহরকে ঘিরে নানা জায়গায় গান গেলে বেড়াতেন অনন্ত ভট্টাচার্য। বলা যায়, অন্তুকাকার হাত ধরেই গানকে ভালোবাসা কালিকাপ্রসাদের। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর ইচ্ছে হয়, কলকাতায় একটা অনুষ্ঠান করবেন। কালিকাপ্রসাদ নিজে তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ফলে পরিকল্পনাটা রীতিমতো সিরিয়াসলিই নিয়েছিলেন তিনি।

অন্তুকাকার সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই হঠাৎ একদিন কালিকাপ্রসাদ খবর পেলেন, অন্তুকাকা আর নেই। ৯০-এর দশকে অনেককিছু ঘটে গিয়েছে পৃথিবীজুড়ে। তরুণ কালিকাপ্রসাদের মনের মধ্যে সেইসমস্ত ঘটনা একটা তোলপাড় তৈরি করেছে। বার্লিনের প্রাচীর ভেঙেছে, ভেঙেছে বাবরি মসজিদও। আবার সোভিয়েত পতনের সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দক্ষিণপন্থী শক্তি। এই ৯০-এর দশকেই কালিকাপ্রসাদ শুনেছিলেন এক নতুন ধারার গান। বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা ছিলই। তবে সেই চর্চা মূলত লোকগান আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলা আধুনিক গানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় এক বন্ধুর দেওয়া উপহারের মাধ্যমেই। একটি গানের রেকর্ড। আধুনিক গান। বেশ অবহেলা ভরেই সেটা রেখে দিয়েছিলেন কালিকাপ্রসাদ। একদিন কী মন হল, বাজালেন সেই রেকর্ড। আর শুনলেন, “ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই”। শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়।

সেইদিনই লোকসঙ্গীতের সঙ্গে একটা অন্য ধারাকেও ভালোবেসে ফেললেন কালিকাপ্রসাদ। এই গানও তো জীবন থেকে উঠে আসা গান। ৯০-এর দশকেই এতগুলো ঘটনা। তবে সবচেয়ে কাছে এসে আঘাতটা লেগেছিল অনন্ত ভট্টাচার্যের মৃত্যুতেই। কাকার কাছে শুধু শিখেই গিয়েছেন। বেঁচে থাকতে কিছু দিতে পারেননি। মৃত্যুর পর কাকার সেই স্বপ্নকেই পূরণ করার দায়িত্ব নিলেন কালিকাপ্রসাদ। কলেজের পড়াশোনা এবং ছাত্ররাজনীতি ব্যস্ত ছিলেন কিছুদিন। তাই সব প্রস্তুতি শেষ হতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন দল তৈরি হল, তা একেবারে অন্যরকম। কলকাতার কোনো গানের দলের সঙ্গে যেন তার চরিত্র মেলে না। শিল্পীরা কেউই যেন কোনোদিন মঞ্চে ওঠার কথা ভাবেননি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ফুচকা বিক্রি করতেন সুদর্শন। কিন্তু তিনি যে অসাধারণ দোতারা বাজান, সেই খবর কেউই রাখতেন না। খোঁজ রেখেছিলেন কালিকাপ্রসাদ। এক লোকাল ট্রেনে সারিন্দা বাজাতে শুনেছিলেন নিরঞ্জন হালদারকে। এভাবেই একদিন দেখা হয়ে গিয়েছিল বিজয়গড়ের বিজ দাসের সঙ্গে। করিমগঞ্জের রাজীব দাসের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল গানের সূত্রেই। আর নতুন দলের জন্য সবাইকে হাজির করলেন কালিকাপ্রসাদ। কলকাতার মঞ্চে একসঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন, একটা উত্তেজনা ছিল সবার মনের মধ্যেই। আর সেইসঙ্গে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাসও।

আরও পড়ুন
মুকেশের বাংলা গানে আপত্তি গ্রামাফোন কোম্পানির, ‘প্রতিশোধ’ নিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

‘দোহার’-ই ছিল কালিকাপ্রসাদের পরিচয়। তবে এর বাইরেও পেশার তাগিদে নানা কাজ করেছেন। কখনও এফএম চ্যানেলের জন্য গানের দায়িত্ব সামলেছেন। কখনও গান নিয়ে গবেষণার কাজেও সাহায্যও করেছেন। গানই ছিল তাঁর জীবন। আদ্যোপান্ত শিল্পী মানুষটি কিন্তু কোনোদিন সেলিব্রিটি হয়ে উঠতে পারেননি। পা থেকেছে সবসময় মাটিতে। আর তেমনই আন্তরিক ব্যবহার করেছেন সকলের সঙ্গে। বিশেষ করে বাংলার সমস্ত শিল্পীকেই যেন এক লহমায় আপন করে নিতেন কালিকা। তা সে যত অখ্যাত শিল্পীই হোন না কেন।

৭ মার্চ, ২০১৭। গাড়ি ছুটে চলেছে শান্তিনিকেতনের দিকে। এই শান্তিনিকেতনের কাছে বারবার বিশ্রাম নিতে ফিরেছেন কালিকাপ্রসাদ। ইচ্ছে ছিল এখানেই একটা গানের স্কুল করবেন। সেই কাজও অনেকটা এগিয়েছিল। সেদিন রতনপুরের বাড়িতে ফোন করতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ফোন ধরলেন কেয়ারটেকার নন্দ। জানালেন, জলখাবারের প্রস্তুতি হয়েই আছে। তাঁরা গিয়ে পৌঁছলেই চায়ের জল চাপিয়ে দেবেন। রাস্তায় শিল্পীর ভাগ্নে সৌম্য একবার বলেছিলেন কিছু খেয়ে নেওয়ার কথা। কালিকাপ্রসাদ রাজি হননি। নন্দ যে অনেক আশা নিয়ে জলখাবার বানিয়ে রেখেছে। সেই আতিথ্যরক্ষা করাটা ভীষণ প্রয়োজন। তেমনই প্রয়োজন দুপুরে সিউড়ির সৃষ্টিধরের বাড়িতে খাওয়াটাও। সৃষ্টিধর তল্লাটের বিখ্যাত ‘সাপনাচুনে’ শিল্পী। এইসব শিল্পীদের খোঁজ হয়তো শুধু কালিকাপ্রসাদই রাখতেন। আর তাঁকেও আপন করে নিতেন সকলে। উপযুক্ত অতিথি সৎকারের সামর্থ্য হয়তো সৃষ্টিধরের নেই। তবু গ্রামের সবার কাছ থেকে কিছু কিছু যোগাড় করে যতটা পেরেছেন আয়োজন করেছেন। কিন্তু নন্দর জলখাবার পড়েই থাকল। পড়ে থাকল সৃষ্টিধরের দুপুরের খাবারের আয়োজনও। সেদিনই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর ঘটে গেল দুর্ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যে ভাঙা গাড়ির নিচে তালগোল পাকিয়ে গেল শিল্পীর শরীর। কালিকাপ্রসাদ চলে গেলেন, পিছনে ফেলে গেলেন বাংলার লোকসংস্কৃতিকে নতুন করে খুঁজে দেখার একটা তাগিদ। একটা মাটির কাছাকাছি যাপন।

আরও পড়ুন
পথে-পথে গান শুনিয়েই উপার্জন, ভগবান মালিকে নতুন বেহালা উপহার নগরপালের

তথ্যসূত্রঃ ‘গান’ স্যালুট, সুতীর্থ দাশ, সঙ্গে কালিকা (সম্পাঃ সুতীর্থ দাশ)

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সরব হয়েছেন অসমের বাঙালি-বিদ্বেষ বা ধর্মীয় বিভাজন নিয়েও, আজকের ভারত দেখলে কী বলতেন কালিকাপ্রসাদ?