কাজ শেষ করে ট্রেন থেকে নামার সময় কুকুরটির সঙ্গে দেখা হত স্টেশনে। বাড়ির দিকে এগোলে, সেও পিছু নিত। কখনও একটু কাছে আসার চেষ্টা করত, কখনও চুপ করে থাকত। আবার কাজে যাওয়ার সময়ও ঠিক হাজির হয়ে যেত সে! লেজ নাড়তে নাড়তে ঠিক চলে আসত। স্টেশনে গিয়ে আবার অপেক্ষা, কখন ফিরবে সে? এইভাবেই চলছিল। একদিন ট্রেন এল। কিন্তু লোকটি আর নামল না ট্রেন থেকে। এইভাবে একটার পর একটা ট্রেন পেরিয়ে যায়, লোকটি আর নামে না। কুকুরটির অপেক্ষার আর শেষ হয় না। অধীর আগ্রহে বসে থাকে তার প্রিয় মানুষটির জন্য। কখন আসবে সে? এই করে নয়টি বসন্ত পেরোল। কুকুরটি জানতে পারল না, লোকটি আর নেই। আর কোনোদিন ট্রেন থেকে নামবে না সে। কী করে বুঝবে; ও কি মানুষের ভাষা বোঝে? কিন্তু আঁচ কি পায় না একটুও? নয় বছর একাগ্র হয়ে বসে থাকা; একদিন সেও চলে যায়। এতদিনের অপেক্ষার পর, প্রিয় মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে এবার। আর কোনো অসুবিধা নেই…
ওপরের গল্পটি একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে না? আজ থেকে ৯৫ বছর আগে জাপানে ঠিক এমনই চিত্রনাট্য তৈরি হচ্ছিল শিবুয়া স্টেশনে। একটি কুকুর আর একটি মানুষের অভিন্ন বন্ধুত্বের গল্প। মৃত্যুও যাতে চিড় ধরাতে পারেনি। মানুষটি চলে গেলেও, তাঁর অপেক্ষায় কুকুরটি থেকে যায় স্টেশনে। দীর্ঘ নয় বছর চলেছিল এমন গল্প। এতক্ষণে কুকুরটিকে নিশ্চয়ই মনে পড়েছে। হ্যাঁ, এ-ই হল হাচিকো। শুধু জাপানের নয়, সারা পৃথিবীর চোখে আঙুল দিয়ে যে দেখিয়েছিল বন্ধুত্বের কথা, বিশ্বাসের কথা।
ঘটনার দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। সময়টা ১৯২৪। টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির কৃষিবিদ্যার অধ্যাপক হিদেসাবুরো ইউয়েনো প্রতিদিন বাড়ির কাছের শিবুয়া স্টেশনে করেই যাতায়াত সারেন। কলেজে যান, পড়ান, তারপর বাড়ি চলে আসেন। এই ছিল রুটিন। হঠাৎই সেখানে হাজির হল এক অতিথি। একটি গোল্ডেন ব্রাউন আকিতা ব্রিডের কুকুর। একসময় তাকে ঘরে নিয়ে এলেন ইউয়েনো। পোষ মানালেন তিনি। নাম রাখলেন, হাচিকো।
সেই থেকে রোজকারের রুটিনে যোগ হয় আরও একটি জিনিস। প্রতিদিন কাজে যাওয়ার সময় ইউয়েনো’র সঙ্গে শিবুয়া স্টেশনে যেত হাচিকো। অধ্যাপকবাবু কাজ টাজ সেরে আবার যখন স্টেশনে নামতেন, তার আগেই একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে হাজির হয়ে যেত সে। তারপর দুজনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতেন।
একদিন একটু অন্য হল যেন। ১৯২৫ সালের ২১ মে। প্রতিদিনের মতো হাচিকো শিবুয়া স্টেশনে এসেছে। অপেক্ষা করছে বন্ধুর জন্য। কিন্তু ট্রেন এসে গেল, দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলেও গেল; ইউয়েনো তো নামল না! কোথায় গেল সে? হাচিকো’র জানার কথা নয়, ততক্ষণে ইউয়েনো আর বেঁচে নেই। সেলিব্রাল হেমারেজ হয়ে মারা গেছেন তিনি; আর ফেরেননি শিবুয়াতে। হাচিকো-র তো জানার কথা নয়। সে তো তার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে। সেই অপেক্ষার যেন শেষ হয় না। এক দিন যায়, দুদিন যায়, কিছুই হয় না! এমনি করে করে ন’টি বছর চলে গেল। হাচিকো-র অপেক্ষা চলতে থাকে। এক মুহূর্তের জন্যও ধৈর্য হারায়নি সে। ঠিক আসবে, তার বন্ধু ঠিক ফিরে আসবে। এভাবে চলে যেতে কেউ পারে নাকি?
একদিন ডাক এল হাচিকো-রও। অপেক্ষার অবসান ঘটাল মৃত্যু। ১৯৩৫ সালে মারা গেল হাচিকো। অপেক্ষা করতে করতেই চলে গেল সে। তবে এবার সে দেখা পাবে তার বন্ধু-র। অন্য জায়গায় তো এবার হাচিকো-র জন্যই অপেক্ষা করে আছে বন্ধু হিদেসাবুরো ইউয়েনো।
জাপানে আজও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় হাচিকো-কে। শিবুয়া স্টেশন তো বটেই, অন্য অনেক জায়গাতেই তার মূর্তি বসেছে। তৈরি হয়েছে ছবি, ডুডল। জাপান, হলিউড এমনকি তামিলেও তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা। জাপানের আয়ামা কবরস্থানে প্রফেসর ইউয়েনো’র সমাধির পাশেই তৈরি হয়েছে ওর কবর। আর টোকিও-র ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ নেচার অ্যান্ড সায়েন্সে গেলেই দেখা যাবে হাচিকো-র স্টাফিং। খুব সহজ কথায়, পশুদের মমি। এই সবকিছুর পাশে থেকে যাবে এই গল্প; যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের শিখিয়ে যায় বন্ধুত্বের আসল সংজ্ঞা…
Powered by Froala Editor