ইন্টারনেটের সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি ইনি, কিন্তু কেন?

আজকের দিনে, ব্রেকফাস্ট কিংবা ব্রাশ করার মতোই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া সার্ফিং। কী কী নোটিফিকেশন এল, তা জানতে ঘুম ভাঙার পরেই মোবাইল হাতড়ান অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই যদি দেখেন আপনার গোপন মুহূর্ত কিংবা নগ্ন ছবি ভাইরাল হয়েছে ইন্টারনেটে? দুঃস্বপ্ন বললেও বোধ হয় কম বলা হবে এই ঘটনাকে। 

আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। এমন একটা সকালই দুর্বিষহ করে তুলেছিল মার্কিন তরুণী কায়লার জীবন। ঘুম ভাঙার পর, ফোন হাতে নিয়ে একটু চমকেই গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় ২০০-রও বেশি নোটিফিকেশন! বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের মেসেজ তো আছেই, সঙ্গে বহু অজানা-অচেনা ব্যক্তিরাও ভিড় করেছেন ইনবক্সে। ব্যাপার কী? নোটিফিকেশন খুলে স্তম্ভিত হয়ে যান কায়লা। তাঁর নগ্ন ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে। মুহূর্তেই যেন কোনো ডেস্টোপিয়ান উপন্যাসের পাতা হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন। 

কিন্তু কীভাবে প্রকাশ্যে এল তাঁর এই গোপন ছবি? নেপথ্যে ছিলেন, মার্কিন যুবক হান্টার মুর (Hunter Moore)। ইন্টারনেটের সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসাবেই পরিচিত যিনি। ‘দ্য মোস্ট হেটেড ম্যান অন দ্য ইন্টারনেট’ (Most Hated Man on The Internet)— আগামী ২৭ জুলাই নেটফ্লিক্সে আসতে চলেছে তাঁর উপর নির্মিত এই বিশেষ তথ্যচিত্র। আর সেই দৌলতেই আরও একবার চর্চায় উঠে এসেছে ঘৃণ্যতম ব্যক্তির নাম। 

‘ইসএনিওয়ানআপ.কম’। চলতি শতকের দ্বিতীয় দশকে সবচেয়ে কুখ্যাত ওয়েবসাইটগুলির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল এই সাইটটি। আর এই সাইটটিরই প্রতিষ্ঠাতা মুর। আজ থেকে ঠিক ১২ বছর আগের কথা। ২০১০ সালে এই ওয়েবসাইটটি তৈরি করেন তিনি। মূলত, প্রতিশোধের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। হ্যাঁ প্রতিশোধ। কারোর ওপর ব্যক্তিগত রাগের প্রতিশোধ নিতেই মানুষ হাজিরা দিতেন মুরের কাছে। বাকি কাজটা ‘দায়িত্ব’-র সঙ্গেই সম্পন্ন করতেন মুর। হ্যাকারদের দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফোন এবং ল্যাপটপে অভিযান চালাতেন তিনি। খুঁজে বার করতেন নগ্ন কিংবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি। তারপর তা আপলোড করতেন নিজের ওয়েবসাইটে। কখনও আবার সঙ্গীর গোপন মুহূর্তের ছবিও স্বেচ্ছায় মুরকে দান করতেন প্রতারকরা। মাত্র দু’বছরের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন মুর ও তাঁর ওয়েবসাইট। এমনকি নিজেকে পেশাদার ‘লাইফ রুইনার’ হিসাবে পরিচয় দিতেন তিনি। 

আরও পড়ুন
সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য কুমারীত্ব পরীক্ষা! ইন্দোনেশিয়ার ঘৃণ্য প্রথার ইতি

২০১২ সালে প্রথম মুরের এই কুকীর্তি প্রকাশ্যে আনেন কায়লা। ইন্টারনেটে গোটা ঘটনার বিবরণ দিয়ে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্য ছিল তাঁর। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে একাধিকবার ছবি সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও হেনস্থার শিকার হন তিনি। আর সেই বুলি পিছনে ছিলেন স্বয়ং মুর। তবে তখনও প্রকাশ্যে আসেনি তাঁর আসল পরিচয়। সেটা আসতে আরও মাস কয়েক সময় লাগে। 

আরও পড়ুন
প্রতিবছর বিশ্বে যৌনাঙ্গ অপসারণের শিকার অসংখ্য মহিলা, ভারতেও প্রচলিত ছিল এই ঘৃণ্য প্রথা

কায়লার এই লড়াই-এ সামিল হয়েছিলেন তাঁর মা শারলট। একটি বীমা কোম্পানির তদন্তকারী হিসাবে কাজ করতেন শারলট। ফলে, ওয়েবসাইটের পিছনে লুকিয়ে থাকা আসল ব্যক্তিটির পরিচয় ও বাসস্থান খুঁজে বের করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাঁর। শুরু হয়েছিল আইনি লড়াই। তবে সেই লড়াইকেও তোয়াক্কা করেননি ঘৃণ্য অপরাধী। বরং, ইন্টারনেট-জুড়ে হঠাৎ করেই ভাইরাল হয়েছিল মুরের গল্প। তাঁর বিরুদ্ধে ক্রুসেডে নেমেছিলেন বহু মানুষ। তবে অবাক করার বিষয় হল, এসবের মধ্যেই তরতরিয়ে বাড়তে থাকে ওয়েবসাইটের ভিউ। গ্রাহক সংখ্যা ছাড়ায় সাড়ে তিন লক্ষের মাত্রা। মাসিক ভিউয়ারের সংখ্যা পৌঁছায় তিন কোটিতে। 

সে-সময় একাধিক সংবাদমাধ্যমেও উঠে এসেছিল মুরের গল্প। একাধিক সাক্ষাৎকারেও ডাকা হয় তাঁকে। তবে সকলের সামনেই মুর স্বীকার করেছিলেন, এতটুকু অপরাধবোধ নেই তাঁর। বরং, অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে ‘মজাদার পন্থা’। হ্যাঁ, এর পরেও প্রায় ২ বছর রমরমিয়ে চলেছিল ‘ইজএনিওয়ানআপ.কম’। অবশেষে ২০১৪ সালে এফবিআই গ্রেপ্তার করে ইন্টারনেটের সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তিকে। অন্যদিকে তাঁর ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় সমস্ত ছবি ও ভিডিও। ওয়েবসাইটটি কিনে অ্যান্টি-বুলিং সাইট গড়ে তোলেন শারলট এবং আরও বেশ কিছু মানুষ। যার মধ্যে ছিলেন রোলিংস্টোন পত্রিকার এক সাংবাদিকও। তবে মুরের ঘৃণ্য অপরাধে রেশ পড়লেও, মাত্র ২ বছর কারাদণ্ডের পরেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে আজও। এক দশক পর নেটফ্লিক্সের তৈরি তথ্যচিত্র ঘিরে ফের একবার চর্চায় উঠে এল সেই বিতর্ক…

Powered by Froala Editor

More From Author See More