এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ‘সফল’ ছাত্র আদতে এক কাল্পনিক চরিত্র!

১০ মার্চ, ২০১৪। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (Georgia Institute Of Technology) বক্তৃতা দেওয়ার জন্য হাজির হন সে-দেশের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা। আসলে শুধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্যই নয়, সঙ্গে সাম্মানিক ডিগ্রিও প্রদানের জন্যও ‘জর্জিয়া টেক’-এ আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ওবামা। চিঠিতে তাঁকে জানানো হয়েছিল, এই বক্তৃতার আগে মঞ্চে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র। জর্জ পি বার্ডেল (George P Burdell)। ১৯৩০ সালে যিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশের একাধিক ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম। 

আমন্ত্রণপত্রে এহেন আহ্বানের কথা দেখে রীতিমতো আপ্লুত হয়েছিলেন ওবামা। একটু হিসেব করে দেখলেই বোঝা যাবে তার কারণ। জর্জ পি বার্ডেল ১৯৩০ সালে স্নাতক হয়ে থাকলে, ২০১৪ সালে দাঁড়িয়ে ১০০-র গণ্ডি ছাড়িয়েছেন তিনি। ফলে, এমন একজন ব্যক্তিত্ব মঞ্চে দাঁড়িয়ে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন রাষ্ট্রপতির— ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গর্বের তো বটেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হওয়ার পর আশ্চর্য এক ঘটনার সাক্ষী হন ওবামা। কোথায় শতায়ু স্নাতক? মঞ্চে যিনি তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁর বয়স যে মেরে-কেটে ষাট-বাষট্টি বছর। আর বারডেল? তিনি কি তবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন কোনো কারণে? জর্জিয়া টেক থেকে বেরিয়ে আসার সময়, দোনামনা করেও কর্তৃপক্ষকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বসেন ওবামা। আর তাতে আরও আশ্চর্য হয়ে যান তিনি। অনুষ্ঠানের আয়োজক, কর্মকর্তারা কেউ নাকি চেনেনই না এই ব্যক্তিকে! তবে কার কথা লেখা হয়েছিল চিঠিতে? কে-ই বা এই জর্জ পি বার্ডেল?

এবার সেই কাহিনিতেই ডুব দেওয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় অবস্থিত জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির তালিকায় অন্যতম— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সবচেয়ে ‘সফলতম’ ছাত্র হলেন আমাদের গল্পের নায়ক জর্জ পি বার্ডেল। তবে মজার ব্যাপার হল, জর্জ পি বার্ডেল আদতে একটি কাল্পনিক চরিত্র। অথচ, বাস্তবেই এই নামে এক ব্যক্তিকে ১৯৩০ সালে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।

একটু খুলে বলা যাক ব্যাপারটা। এই গল্পের শুরু ১৯২৬ সালে। সেবার জর্জিয়া ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য ফর্ম তুলেছিলেন উইলিয়াম এডগার স্মিথ নামের এক তরুণ। পরবর্তীতে যিনি হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা প্রযুক্তিবিদ ‘এড স্মিথ’। জর্জ পি বার্ডেল আদতে তাঁরই ‘ব্রেইনচাইল্ড’। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম নথিভুক্ত করার সময়, কর্তৃপক্ষের থেকে একটির বদলে দুটি ফর্ম পেয়েছিলেন এড স্মিথ। যার মধ্যে একটি ফর্ম জমা দিয়েছিলেন নিজের নামে, অন্যটি কাল্পনিক চরিত্র জর্জ পি বার্ডেলের নামে। 

তবে ব্যাপারটা যে শুধু তিনি একাই জানতেন এমনটা নয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ক্লাসের প্রায় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল বিষয়টা। স্মিথ নিজে তো বটেই, তাঁর সহপাঠীরাও ক্লাসে রোলকলের সময় ‘উপস্থিতি’ জানাতেন বার্ডেলের নামে। এমনকি প্রতিটি অ্যাসাইনমেন্টের ক্ষেত্রে, ভিন্ন হস্তাক্ষরে ভিন্ন ভাষাশৈলীতে জর্জের নামে পৃথকভাবে ফাইলও জমা করেছিলেন স্মিথ। 

মজার বিষয় হল, চার বছরেও এই সহজ মজাটা ধরতে পারেননি জর্জিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা। ১৯৩০ সালের জুন মাসে জর্জ পি বার্ডেলকে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়। আর তারপরই প্রকাশ্যে আসে এই ঘটনার কথা। কর্তৃপক্ষ জানতে পারেন, এই গোটা বিষয়টিই ছিল আদতে একটি প্র্যাঙ্ক। 

তবে এখানেই থেমে থাকেনি জর্জ পি বার্ডেলের কিংবদন্তি। বরং, দশকের পর দশক ধরে জর্জিয়া ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা তাঁর এই কিংবদন্তিকে বয়ে নিয়ে চলেছেন এখনও। জর্জিয়া ইনস্টিটিউটের একাধিক অনুষ্ঠানে, রেজিস্টারে আজও খুঁজে পাওয়া যায় বার্ডেলের নাম। নেপথ্যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরাই। তাঁরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার হ্যাক করে বিভিন্ন রেজিস্টারে গুঁজে দেন বার্ডেলের নাম। পাশাপাশি বার্ডেলের নাম নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেও নানান মজার কাণ্ড বাধিয়েছেন জর্জিয়া ইনস্টিটিউটের প্রাক্তনীরা। 

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে কিংবদন্তি মার্কিন পত্রিকা ‘ম্যাড’-এর পরিচালক সমিতির কথা। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই পত্রিকার পরিচালক সমিতিতে হাজির ছিলেন বার্ডেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে বোমাবর্ষণ করা বি-১৭ বোমারু বিমানের ক্রু সদস্যদের তালিকাতেও ছিল বার্ডেলের নাম। পরবর্তীতে যা চিহ্নিত করে বাদ দেওয়া হয় রেজিস্টার থেকে। ২০০১ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব’-দের তালিকায় মনোনয়ন পেয়েছিলেন বার্ডেল। এমনকি জর্জিয়া টেকের গুগেনহাইম স্কুল অফ এরোস্পেসের তৈরি স্যাটালাইটে একটি ধাতব প্লেটে খোদাই করে বার্ডেলের নাম লিখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদরা। 

বলাই বাহুল্য, এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। তবে ২০১৫ সালে বারাক ওবামার ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিশেষভাবে উঠে আসে জর্জ পি বার্ডেলের নাম। এমনকি এই ঘটনার পর জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও বার্ডেল-কিংবদন্তি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জানায়, জর্জ পি বার্ডেল আদতে একটি কাল্পনিক চরিত্র। তবে তারপরও ঠেকানো ইতি পড়েনি বার্ডেল-কিংবদন্তিতে। আজও দিব্যি জর্জিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের হাত ধরেই বেঁচে আছেন ‘শতায়ু’ বার্ডেল!

এই গল্পের শেষে আরও একটা মজার বিষয় বলে রাখা যাক। ভর্তির ফর্ম ভরার সময় বার্ডেলের জন্ম তারিখ হিসাবে এড স্মিথ বেছে নিয়েছিলেন ১ এপ্রিল তারিখটিকে। আদতে যা এপ্রিল ফুলের দিন। তবে তাঁর এই সামান্য মজা যে এত বছর স্থায়ী হবে, তা কি নিজেও জানতেন এড স্মিথ? 

Powered by Froala Editor