‘এখানে প্রস্রাব করবেন না, করলে ৫০০ টাকা জরিমানা!’ কলকাতার অলিতে-গলিতে এ-ধরনের দেওয়াল লিখন দেখা যায় হামেশাই। কিন্তু কখনও কখনও যতিচিহ্নের সামান্য ভুলেই ঘটে যায় ভয়াবহ অর্থবিপর্যয়। উদাহরণ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে উপরিউক্ত বাক্যটিকেই। কমি চিহ্নটি ‘না’-এর পরে না বসে, আগে ব্যবহৃত হলেই সম্পূর্ণ উল্টে যায় সতর্কবার্তাটির অর্থ। তাতে হিতে বিপরীত হয়ে বসে পরিস্থিতি। শুধু দেওয়াল লিখনই নয়, যতিচিহ্নের (Punctuation Mark) ভুল ব্যবহারে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক গুজব, কখনও আবার হিংসাত্মক হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। তবে একটিমাত্র যতিচিহ্নের ভুল ব্যবহারের জন্য যদি একধাক্কায় ২ কোটি মার্কিন ডলার মাশুল গুনতে হয়?
আজ থেকে ৬০ বছর আগে এমনই এক আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী থেকেছিল দুনিয়া। সামান্য একটি হাইফেনের জন্যই প্রায় ২০ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি মার্কিন ডলারের ধাক্কা সামলাতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। ঠাট্টার শিকার হতে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। ‘ঐতিহাসিক’ এই যতিচিহ্নটি আজ পরিচিত ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাইফেন’ বা ‘মোস্ট এক্সপেন্সিভ হাইফেন ইন দ্য হিউম্যান হিস্ট্রি’ (Most Expensive Hyphen In Human History) নামে।
অবশ্য হাইফেন বলা হলেও, যে-চিহ্নটির জন্য এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতির ভার বহন করতে হয়েছিল মার্কিন প্রশাসনকে, সেটি আদতে একটি ওভারবার। ওভারবার আকারে হুবহু হাইফেনের মতো হলেও, তা শব্দের পরে ব্যবহৃত হয় না। বরং, তা বসানো হয় শব্দ বা কোনো অক্ষরের মাথায়। কোনো বিশেষ অক্ষরের উচ্চারণের তারতম্য বোঝাতে লেখার সময় সেই অক্ষরের মাথায় ব্যবহৃত হয় ওভারবার। আবার বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাশিকে অক্ষরের মাধ্যমে উপস্থাপনের সময়ও ব্যবহৃত হয় এই চিহ্নটি। তবে ওভারবারের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটাও পরিচিত না হওয়ার কারণেই ‘হাইফেন’ নামেই স্বীকৃতি পায় এই চিহ্নটির ‘ঐতিহাসিক’ ভুল ব্যবহার। কিন্তু ঠিক কী বিপত্তি ঘটিয়েছিল এই চিহ্নটি?
১৯৬২ সাল। বুধ, শুক্র এবং মঙ্গল— এই তিনটি গ্রহের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে সে-বছর মহাকাশে ১০টি স্পেস-প্রোব পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মেরিনার স্পেস প্রোগ্রাম খ্যাত এই প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল শুক্র গ্রহে পাঠানো একটি স্পেস প্রোবের উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। আর সেখানেই ঘটে যায় বিপত্তি।
ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ২২ জুলাই, ১৯৬২। যুক্তরাষ্ট্রের কেপ ক্যানাভেরাল লঞ্চপ্যাড থেকে উৎক্ষেপিত হয় ‘মেরিনারস স্পেস প্রোগ্রাম’-এর ‘ভিনেস প্রোব’। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯টা বেজে ২১ মিনিট। প্রাথমিকভাবে উৎক্ষেপণ সফল হলেও, কয়েক মিনিটের মধ্যেই রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ পড়ে নাসার গবেষকদের কপালে। উৎক্ষেপিত রকেট যে ঠিক পথে যাচ্ছে না, তা খালিচোখে বুঝতেও বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি গবেষকদের। এমনকি সুপারকম্পিউটারের রিডিং-ও দেখায় শুক্রে না গিয়ে এই মহাকাশযান ফিরে আসবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই। এমনকি পৃথিবীতে আঘাত করে ঘটাতে পারে বড়ো কোনো দুর্ঘটনা। ফলে, বাধ্য হয়েই মাঝ-আকাশেই মহাকাশযানটি ধ্বংস করে দিতে বাধ্য হয় নাসা। উড়ান নেওয়ার মাত্র ২৯৩ সেকেন্ডের মধ্যেই ছাই হয়ে যায় ‘মেরিনার-১’-খ্যাত ‘ভিনেয়াস প্রোব’। পরিণত হয় দৈত্যাকার আতশবাজিতে।
নাসার এই ব্যর্থ মহাকাশাভিযানের কারণে তৎকালীন সময়ে একধাক্কায় ক্ষতি হয়েছিল ১৮.৫ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৮৫ লক্ষ ডলারের। আজকের বাজারদরে যার অর্থ প্রায় ১৫৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৫ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলার। বলার অপেক্ষা থাকে না, এই আশ্চর্য ঘটনা সে-সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঠাট্টা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, তেমনই অন্যদিকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন ট্যাক্স-প্রদানকারী মার্কিন নাগরিকরাও। কিন্তু কী-কারণে হঠাৎ ভুল পথে অগ্রসর হল এই মহাকাশযান?
প্রশ্নের উত্তর পেতে, বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে নাসা এবং মার্কিন প্রশাসন। বিস্তৃত তদন্তের পর প্রকাশ্যে আসে, আদতে এই বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে একটি ভুল যতিচিহ্নের প্রয়োগ। আসলে সংশ্লিষ্ট মহাকাশ অভিযানের জন্য নাসার গবেষকরা খাতায়-কলমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং তৈরি করেছিলেন, পরবর্তীতে হাতে লেখা সেই প্রোগ্রামিং-এর ডিজিটাল প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন টাইপরাইটাররা। যা সরাসরি পরবর্তীতে সুপার কম্পিউটারে আপলোড করা হয় পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে। এই ট্রান্সক্রিপশন চলাকালীনই, বদলে গিয়েছিল বিশেষ একটি গাণিতিক অপারেটরের সহকারী চিহ্ন। ‘আর এন ডট’-খ্যাত এই চিহ্নটির মাথায় ওভারবার বা হাইফেনের ব্যবহার না-করার ফলে বদলে যায় মহাকাশযানটির কক্ষপথের ব্যাসার্ধ। ফলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বাইরে সম্পূর্ণভাবে না-গিয়েই বায়ুমণ্ডলে প্রত্যাবর্তন করে সেটি। ঘটে যায় বিপর্যয়।
বলাইবাহুল্য, এই ভুল শুধরে পরের বছর ফের উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ‘মেরিনার ১’-এর অনুরূপ আরও একটি স্পেস প্রোব। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুনিয়ায় এক ঐতিহাসিক অধ্যায় রয়ে যায় ‘মেরিনার ট্র্যাজেডি’। অন্যদিকে এই ট্র্যাজিডিকে ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাইফেন’-এর তকমা দেন বিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক আর্থার সি ক্লার্ক।
Powered by Froala Editor