ক্যানভাস থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে একটি শিশু। তার দু’চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে জলের ধারা। ছবিটির দিকে তাকালে মনে হবে তৃষ্ণা কিংবা খিদের দহন যেন অশান্ত করে তুলেছে তাকে। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপজুড়ে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই চিত্রশিল্পটি। বিশেষ করে পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে বিক্রি হয়েছিল এই ছবিটির প্রায় ৫০ হাজারের বেশি কপি। হয়ে ওঠে মানবিকতার প্রতীক। তবে এই ছবির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে কুখ্যাতির ছায়া।
হ্যাঁ, এই ক্রন্দনরত নিষ্পাপ শিশুর ছবিটিই নাকি ‘ইউরোপের সবচেয়ে অভিশপ্ত চিত্রকলা’ (Most Cursed Painting)। কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েও কীভাবে অভিশপ্ত হয়ে উঠল এই ছবি? কে-ই বা এই ছবির স্রষ্টা? খুলে বলা যাক সেই কাহিনি।
দিনটা ছিল ১৯৮৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় অ্যাসেক্সের একটি বাড়ি। কারোর প্রাণ যায়নি ঠিকই, কিন্তু সঠিক সময়ে পৌঁছেও আগুন নেভাতে ব্যর্থ হন দমকলকর্মীরা। ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল প্রায় সবকিছুই। তবে এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেও এক দমকলকর্মী খুঁজে পান কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা ক্রন্দনরত শিশুটির ছবি। যা পরিচিত ‘দ্য ক্রাইং বয় হিসাবে’। বাড়ির কাঠের দেওয়াল পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কীভাবে আগুনের লেলিহান শিখার থেকে বেঁচে গিয়েছিল এই ছবি, তা একপ্রকার রহস্যই।
তবে একবার নয়। এর পরও অ্যাসেক্স এবং ব্রিটেনের অন্যান্য প্রদেশেও নাকি ঘটতে দেখা যায় একই ঘটনা। তেমনটাই অভিযোগ করেছিলেন দমকলকর্মীরা। স্বাভাবিকভাবেই ফলাও করে এই খবর ছাপা হয় ব্রিটেনের প্রথম সারির ট্যাবলয়েড ‘দ্য সান’ পত্রিকায়। প্রায় দাবানলের মতোই সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপজুড়ে। শুরু হয় এই ছবিটির অতীত অনুসন্ধান।
আরও পড়ুন
রক্ত দিয়ে আঁকতেন ছবি! প্রয়াত বিতর্কিত অস্ট্রিয়ান চিত্রকর
সেই সময়ই বিভিন্ন নথি খুঁড়তে বেরিয়ে আসে মূল ছবিটির স্রষ্টার নাম। জানা যায় ছবিটি নাকি ইতালীয় চিত্রকর জিওভানি বারগোলিন-এর আঁকা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন নামের কোনো শিল্পীর অস্তিত্বই নেই ইতালিতে। নেই কোনো নথিও। এখানেই আরও রহস্যজনক মোড় নেয় ‘দ্য ক্রাইং বয়’-এর গল্প।
আরও পড়ুন
গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ কমছে সমুদ্রের জলতল! বিপরীত ছবি আইসল্যান্ডে
এর পর থেকেই ধীরে ধীড়ে ছড়িয়ে পড়ে একাধিক জনশ্রুতি। কেউ দাবি করেন, ছবির এই ক্রন্দনরত শিশুর কান্না নাকি তাঁরা নিজেই শুনেছেন বাড়িতে। কারোর দাবি, এই শিশুর কান্না সর্বনাশ ডেকে আনে। এই ছবির ‘কু-প্রভাবে’ প্রিয়জন হারিয়েছেন, এমনও অভিযোগ করেছেন অনেকে।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ শিল্পীর আঁকা ছবির ‘প্রদর্শনী’ চাঁদে
আশির দশকের শেষের দিকে এইসব জনশ্রুতির কারণেই ইউরোপের নানান জায়গায় বনফায়ারে জ্বালানো হয় ‘দ্য ক্রাইং বয়’-এর ছবি। এমনকি বহুমূল্য ফ্রেমে বাঁধানো এই ছবি, সেসময় ডাস্টবিনে ফেলেও দিয়েছেন বহু মানুষ। কিন্তু আদতে কি সত্যিই এমন কোনো অতিলৌকিক ঘটনা জড়িত এই ছবির সঙ্গে?
অন্তত ব্রিটিশ লেখক ও কমেডিয়ান স্টিভ পান্টের বক্তব্য ভিন্ন। দীর্ঘ গবেষণার ও অনুসন্ধানের পর তিনি জানিয়েছিলেন, সম্ভবত ‘ফায়ার রিটারডেন্ট’ বা অগ্নিনির্বাপক পদার্থের সাহায্য ভার্নিশ করার ফলেই একাধিক অগ্নিকাণ্ডে আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়েছিল এই ছবির বেশ কয়েকটি কপি। পাশাপাশি দেওয়ালে ছবির পিছনের দিকটা আটকানো থাকায় প্রথম আগুনের সংস্পর্শে এসেছিল সেদিকটাই। ফলে, মূল ছবিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি প্রতিক্ষেত্রেই। বিবিসি রেডিও-তেও তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন তাঁর এই গবেষণাধর্মী তত্ত্ব। পাশাপাশি এও উঠে আসে, এই ছবিটির আসল স্রষ্টা নাকি ফরাসি শিল্পী ব্রুনো আমেডিও।
স্টিভ পান্টের তত্ত্ব একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না হলেও, তাঁর শো-এর পরেও সামান্যতম বদল আসেনি সাধারণের মানসিকতায়। আজও ইউরোপের অভিশপ্ততম ছবি হিসাবেই পরিচিত এই ছোট্ট শিশুটির চিত্র। কয়েকটি স্টুডিও ও গ্যালারিতে থাকলেও, অনাদরেই পড়ে রয়েছে এককালের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই চিত্রশিল্পটি…
Powered by Froala Editor