হার মানায় হলিউড-কেও; মোনালিসা বাঁচানোর নেপথ্যে কারা এই মনুমেন্ট ম্যান?

সে এক ধ্বংসলীলার সময়ই বটে। পোকামাকড়ের মতোই একদিকে যেমন মরছে মানুষ, তেমনই মানুষের তৈরি অপূর্ব সৌধ, মিনার, ভাস্কর্য কিছুই বাদ যাচ্ছে না হিটলারের নাৎসিদের হাত থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় ইতিহাসের বিশিষ্ট স্রষ্টাদের অসংখ্য শিল্পকর্ম, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য নাৎসিরা দখল করেছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, এই চুরি হওয়া অনেকগুলি কাজ, শুধু কোটি কোটি ডলার দিয়ে যার মূল্য ঠিক করা যায় না, উদ্ধার করা গিয়েছিল একটি গোপন দলের সাহায্যে। পরবর্তীতে সেই দল পরিচিতি পায় ‘মনুমেন্ট মেন’ নামে।

কারা ছিলেন এই ‘মনুমেন্ট মেন’? বেসামরিক ও সামরিক, উভয় পক্ষের মানুষদের নিয়েই তৈরি হয়েছিল এই ‘মনুমেন্ট মেন’ গোষ্ঠী। তবে বেসামরিক মানুষজনই ছিলেন বেশি। স্মৃতিসৌধ, চারুকলা এবং সংরক্ষণবিদ, ইতিহাসবিদ, স্থপতি, যাদুঘর কিউরেটর এবং অধ্যাপকদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই দল। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যবয়স্ক পুরুষ, যাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবুও, লক্ষ লক্ষ অমূল্য ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করার জন্য গোপনে এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক মিশন কার্যকর করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল তারা।

কী বলছে ইতিহাস আমাদের? ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করার পরে ধ্বংস এবং বিশৃঙ্খলা নেমে আসে ইউরোপে। ইউরোপের প্রতিটি ইঞ্চিতে অত্যাচার ও লুণ্ঠন শুরু করে নাৎসিরা। প্রতিরোধের উপায় হিসেবে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সালটা ১৯৪১। ইউরোপ তখন প্রায় জার্মানি এবং অপর মিত্রশক্তি ইটালি ও জাপানের নিয়ন্ত্রণে। এই শক্তি শুধুমাত্র নিরীহ মানুষদেরই শেষ করছিল না, তাদের চিহ্ন হিসেবে চুরি অথবা ধ্বংস করছিল বিভিন্ন শিল্পকর্মও। নিহত ও নির্বাসিতদের কাছে বহু মূল্যবান শিল্পকর্ম ছিল। জাদুঘর, গ্যালারি বা অন্যান্য জায়গার থেকেও নাৎসিরা সেগুলো লুট করতে বা চুরি করতে দ্বিধা করেনি।

আরও পড়ুন
মোনালিসার হাসি কীভাবে এঁকেছিলেন ভিঞ্চি? পাঁচ শতক পরে সমাধান রহস্যের

মজার ব্যাপার হল, জার্মানির অত্যাচারী নেতা হওয়ার আগে অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিল্পী। যদিও যুবক বয়সে একটি আর্ট স্কুল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। তবু তিনি শিল্পের প্রশংসক ছিলেন এবং নিজেও ছবি আঁকতেন। অস্ট্রিয়ার লিনজ শহরে তিনি ‘ফুয়েরার মিউসিয়াম’ নামে একটি বেসরকারি যাদুঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত শিল্পকর্ম থাকবে এখানেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই হিটলারের কমান্ডিং জেনারেলরা পুরো ইউরোপ জুড়ে শিল্প ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলির পদ্ধতিগত লুটপাট করার দায়িত্ব নিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল যে, নাৎসিরা যে সমস্ত ধন-সম্পদ লুট করেছিল সেগুলি থাকবে প্যারিসের জাদুঘরে। তবে বর্বর নাৎসিরা জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া জুড়ে লবণের খনিতে লুকিয়ে রাখে সেই অমূল্য সম্পত্তি।

আরও পড়ুন
মিউজিয়াম থেকে চুরি গেল মোনালিসা, নকল ছবি বিক্রি করে কোটিপতি আর্জেন্টিনার ব্যবসায়ী

কাদের শিল্পকর্ম ছিল এর মধ্যে? অসংখ্য শিল্পীর মধ্যে ছিল র্যা মব্র্যান্ট, পিকাসো, ম্যাটিস, জোহানেস ভার্মির, ভ্যান গঘের মতো শিল্পীর কাজ। ছিল মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ভাস্কর্য ‘ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড’।

আরও পড়ুন
এবার থেকে দৃষ্টিহীনরাও উপভোগ করবেন মোনালিসার ছবি

যুদ্ধের বিপর্যয় থেকে সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলিকে রক্ষার জন্য মিত্র অভিযান বাহিনীর স্মৃতিসৌধ, চারুকলা ও সংরক্ষণাগার বিভাগ (এমএফএএ) নামে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। স্মৃতিসৌধের নামকরণ করা এই ইউনিটটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গির্জা এবং জাদুঘরগুলির মতো সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ রক্ষার জন্য, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের মূল্যায়ন এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্পের কাজ করার জন্য। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো তৈরি হল শিল্প রক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্রিগেড।

যুদ্ধ যতই এগোতে থাকে, নাৎসিদের চুরি করা কাজগুলি ডকুমেন্টিং এবং পুনরুদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গেই আরও চুরি আটকাতেও দিনরাত এক করে দিয়েছিল এই গোষ্ঠী। তাদের বৃহত্তম সাফল্যগুলির মধ্যে একটি হল খুব বিখ্যাত একটি ছবিকে ফরাসি পল্লীর বিভিন্ন বাড়িতে দক্ষতার সঙ্গে লুকিয়ে রেখে রেখে নাৎসিদের নাগালের বাইরে রাখা, যে ছবিটা বিশ্বের ইতিহাসে পরিচিত ‘মোনালিসা’ বলে।

“আমাদের কাছে ট্রাক ছিল না; কোনও জিপ ছিল না। আমাদের জুতো ছাড়া আর কিছুই ছিল না।” জানিয়েছিলেন সেই দলের এক সদস্য।

এই গ্রুপের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন রোজ ভাল্যান্ড। তিনি ছিলেন আর্ট কিউরেটর এবং প্যারিসের জিউ ডি পাউম যাদুঘরের কর্মীদের একমাত্র সদস্য, যাকে বহাল করেছিল স্বয়ং নাৎসিরাই। নাৎসিরা কী করে জানবে যে, ভাল্যান্ড জার্মান ভাষায় যথেষ্ট সাবলীল এবং তিনিই নাৎসিদের পরিকল্পনাটি পৌঁছে দেবেন ফরাসি প্রতিনিধিদের কাছে। ‘মনুমেন্ট মেন’ দলের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন জর্জ স্টাউট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করা স্টাউট ছিলেন আদতে একজন হার্ভার্ড আর্ট কনজারভেটর, যিনি সংরক্ষণের নতুন কৌশল অর্জন করেছিলেন।

এই অসম্ভবকে সম্ভব করা মানুষগুলোর কাজ নিয়ে তৈরি হয়েছিল ২০১৪ সালে ‘মনুমেন্ট মেন’ নামের চলচ্চিত্র। জর্জ ক্লুনির মতো অভিনেতা অভিনয় করেছিলে তাতে। পরে সেই কালো অধ্যায় নিয়ে নিজের মন্তব্যে জানিয়েছিলেন, নাৎসিদের হাত থেকে শুধুই মূর্তি তো নয়, মানব সভ্যতার অসামান্য কিছু দলিলও যে হারিয়ে যেত চিরতরে তারা না থাকলে!

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More