নিজস্ব ভাষা আছে মনেরও, একাকী মানুষের সেই স্বর আসলে স্বপ্নের দেশে বিচরণ

একটা ছেলে হলুদ ট্যাক্সি করে ঘুরে বেড়ায়। স্বপ্নে কোনো ট্রাফিক থাকে না, চেকপোস্টও নয়। বাবা, মা, প্রেমিকা, বন্ধু, দাদারা- সবাইকে নিয়ে সমুদ্র হতে চায় সে। তৈরি করবে নতুন বাড়ি; দু'পশলা বৃষ্টির মধ্যে ডেকে উঠবে আত্মীয়ের পোষ্য। কিন্তু বৃষ্টি তো বেড়েই চলেছে! আস্তে আস্তে ভেসে যাচ্ছে বাড়ি, ভেসে যাচ্ছে ডাক। সমুদ্র কোথায় যেন সরে গেছে হঠাৎ। ধু ধু মাঠে একটা ট্যাক্সি পড়ে আছে শুধু। গা থেকে হলুদ রঙ খুলে, মিশে গেছে বালিতে। ছেলেটা খুঁজে পাচ্ছে না স্টিয়ারিং হুইল। পাশের মানুষগুলো চটি খুলে চলে গেছে কোথায় যেন! ছেলেটা পড়ে আছে একা মাঠে; ভাষা নেই… শব্দ নেই…

সেই আদিম মানবের সময় থেকে ভাষাকে আশ্রয় করে আমরা বেড়ে উঠছি। একদিন যা ছিল হাতে-মুখে-ইশারায়; পরে সেটাই নতুন রূপ পেল বিভিন্ন লিপিতে। আজ দেখুন, কত রকম ভাষা আমাদের চারিপাশে গিজগিজ করছে! লেখার ভাষা, মুখের ভাষা, পোষ্যের ভাষা, ঝরে পড়া পাতার ভাষা। কিন্তু এসবের আড়ালেও যে ভাষার আরও একটি স্তর রয়েছে। সবসময় দেখা যায় না তাকে, কেউ শখ করে দেখতেও চায় না সেসব। কিন্তু চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেওয়ার আগে যে মানুষটি প্রবলভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, তার ভাষা কে শুনবে? বা ওই যে ছেলেটা একা একা বসে রয়েছে ট্যাক্সির ভেতর। তার পাশ থেকে সরে গেছে ছায়ারা— তার একা বেঁচে থাকার ভাষা কে জানবে?

কথ্য ভাষার বিবর্তন হয়েছে অনেক। ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলেই তার নিদর্শন জানতে পারব আমরা। মহেঞ্জোদারো, মিশর থেকে আজকের ইংরেজি, বাংলা- মাতৃভাষারও আদল বদলেছে। কিন্তু স্বপ্নের ভাষা, বন্ধ ঘরে ক্রমশ পুড়তে থাকা মানুষটির ভাষা? না, সেটা বদলায়নি। ইউনেস্কোর তালিকায়, বা ভাষার ইতিহাস গবেষণায়ও এরা উঠে আসেনি। অথচ আবহমান কাল ধরে তাদের আর্ত-ভাষা খবরের খোরাক হয়েছে। শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে পোস্টমর্টেম। ছাপা অক্ষরে, স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে মুক্তির কারণ। শুধু, আওয়াজটাই আটকে থাকল বন্ধ ঘরের ওপারে। যাদেরকে বলতে চাইছিল, তারা তখন অন্য কিছুর পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত…

শরীর ও মন- সব কিছুর বদল হলেও, এই দুটো থেকে গেছে আমাদের সঙ্গে। শরীরেরও যেমন ভাষা আছে, তেমনই রয়েছে মনের ভাষা। যার কিছুটা আমরা ব্যক্ত করি পুরো জীবনে; চলতে ফিরতে সেই ভাষাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আমাদের। কিন্তু আরও কিছুটা যে থেকে যায় ভেতরে! যে কথা হয়ত বেরোয় কারোর সামনে। কেউ কেউ আবার সারাটা জীবন বয়ে নিয়ে চলে সেসব। মাঝ রাত্তিরে, যখন আর কেউ জেগে নেই, প্রকৃত অর্থেই পৃথিবী একা; তখন এসব কথোপকথন শুরু হয়। অন্ধকারের বুকে ছায়ারাও মিলিয়ে যায়। থেকে যায় নিজেদের শুদ্ধতম কিছু কথা, কিছু ভাষা। পৃথিবীর অনেক লোককথা বলে, ভোররাত নাকি শয়তানের সময়। অতৃপ্ত আত্মারা সেই সময় নেমে আসে। শয়তান কিনা জানা নেই; কিন্তু সত্যিই তখন ‘অতৃপ্ত’দের কাঁদার সময় যে! ভগবানরাও তখন শয়ন করে। চলে যাওয়ার আদর্শ সময় নয় কি!

মনের কথাকে আমরা অনেকেই গুরুত্ব দিই না। নিজের মতো করে জীবন উদযাপন নয়, আপোষ করে করে বেঁচে থাকাকেই অনেকে পাথেয় করে নেয়। তার ফল? ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মনের কথা না শুনতে পাওয়ার জন্য, বা কেউ না শোনার জন্য নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে স্রেফ এই কারণে। ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা চিৎকার করে যাই। পাশে থাকা মানুষগুলো রাতারাতি ছেড়ে চলে যায়। ভাষা হারাই আমরা। হ্যাঁ, ভাষা শুধু তৈরিই হয় না; হারিয়েও যায় মাঝে মাঝে। তখন কেবল, ফেলে যাওয়া চটি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা…

বাঁচতে তো সবাই চায়। বাঁচার একটা ভাষা, আমার বাঁচতে চাওয়ার আরেকটা ভাষা। প্রবল ছটফটানির মধ্যে একটু শ্বাস নেওয়া আর কি। আচ্ছা, স্বপ্নের ভাষা কীরকম? ট্যাক্সির ভেতরে আটকে পড়া ছেলেটার ডায়েরিতে লেখা ছিল প্রশ্নটি। উত্তর দিতে পারবেন কেউ? নিজেদের ভাষাতেই বলতে পারেন। চাইলে চলেও আসতে পারেন মাঠের ধারে। খোলা শীতের হাওয়ায়, একা একা চিৎকার করছে কে যেন! ছেলেটা বুঝতে পারে না। ফেলে যাওয়া চটিগুলো একটিবার ছুঁয়ে, সরে পড়ে এক কোণে। বোঝে না, ও কী করেছে। জানেও না কিছু। শুধু শোনে, কে যেন চিৎকার করছে রাস্তায়। করেই যাচ্ছে… ছেলেটা দিব্যি বুঝতে পারছে সেই ভাষা…

মনের ভাষাদিবস কি কখনও হয় না? স্বপ্নের ভাষাদিবস? কই, কেউ তো কিছু বলে গেল না ছেলেটাকে এই ব্যাপারে…

More From Author See More