কচ্ছপ শিকার ছেড়ে সংরক্ষণকেই ‘পেশা’ করে নিয়েছে যে-পরিবার

১৯৯০ সাল। কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করেছিল মেক্সিকান (Mexico) সরকার। ঘোষণা করেছিল, সামুদ্রিক কচ্ছপ শিকার এবং কচ্ছপের ডিম চুরি করা আইনত অপরাধ। তবে এই আইন তৈরির পরই যে বদলে গেছে পরিস্থিতি, এমনটা নয়। বিশেষত ‘বাহিয়া দে কিনো’ (Bahia De Kino) বার্ষিক উৎসবের সময় উপকূলীয় মেক্সিকোয় দেদার শিকার হত অলিভ রিডলি এবং গ্রিন সি টার্টল প্রজাতির কচ্ছপ (Sea Turtle)। আসলে এই উৎসবে কচ্ছপের মাংস খাওয়াই রীতি মেক্সিকানদের। 

কচ্ছপ শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার পরও, কচ্ছপের মাংসের চাহিদা মেটাতে তাই রাতের অন্ধকারে একসময় লুকিয়ে-চুরিয়ে কচ্ছপ শিকার করতেন কিনো বে অঞ্চলের মৎস্যজীবী কসমে বেকেরা। শুধু শিকারই নয়, এমনকি শিকার করা কচ্ছপটিকে হত্যাও করতে হত তাঁকেই। তার জন্য মোটা অঙ্কের টাকাও পেতেন তিনি। বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার খরচ চলত তা দিয়ে। তিন দশক পর আজ তিনিই ‘দে কিনো’ উপসাগরে কচ্ছপদের রক্ষাকর্তা। শুধু কসমেই নন, তাঁর গোটা পরিবারই আজ অক্লান্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য। 

নব্বই-এর দশকের শেষ দিক সেটা। প্রতিবছরের মতোই বার্ষিক উৎসবের আগে প্রকাণ্ড এক সামুদ্রিক কচ্ছপ শিকার করে বাড়িতে এনেছিলেন তিনি। তবে সারা রাত কচ্ছপের ‘চিৎকারে’ ঘুম হয়নি তাঁর। কসমের কথায়, গোটা রাত ধরে কেঁদেছিল গ্রিন সি প্রজাতির কচ্ছপটি। পরদিন ক্রেতাদের চাহিদা উপেক্ষা করেই, কচ্ছপটিকে সমুদ্রে ছেড়ে দেন তাঁর স্ত্রী। সেই শেষবারের মতো কচ্ছপ শিকার। এরপর মাছ ধরেই দিন কাটত তাঁর। তবে আকস্মিকভাবেই তাঁর ভাগ্য বদলে যায় ২০০৭ সালে। 

গবেষণার জন্য দলবল নিয়ে মেক্সিকোয় হাজির হয়েছিলেন অ্যারিজোনা-ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘প্রেসকট সেন্টার’-এর বিজ্ঞানীরা। তবে স্থানীয়দের সাহায্য ছাড়া কি গবেষণা চালানো সম্ভব? ফলে শুরু হয়েছিল সামুদ্রিক পরিবেশের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এমন মানুষদের সন্ধান। সেই সূত্রেই গবেষকদের সঙ্গে সমীক্ষার করার সুযোগ পেয়ে যায় কসমে। এর বছর তিনেক পর, তাঁর কাজে খুশি হয়ে কচ্ছপ সংরক্ষণের প্রকল্পে তাঁকে নিয়োগ করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। ব্যবস্থা করে গ্রান্টের। 

সেই শুরু। ২০১০ সাল থেকে তিনি ও তাঁর পরিবারই হয়ে উঠেছেন সামুদ্রিক কচ্ছপদের রক্ষাকর্তা। কাজ বলতে সারাদিন স্টিমারে চেপে উপসাগরে ঘুরে বেড়ানো। সামুদ্রিক কচ্ছপদের ধরে উপকূলে নিয়ে আসা। তারপর তাদের দেহের দৈর্ঘ্য, ওজন ও অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নথিভুক্ত করে, পিছনের ফ্লিপারে ট্যাগ লাগিয়ে পুনরায় সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া। ঘোস্ট গিয়ার অর্থাৎ পরিত্যক্ত মাছ ধরার জালে আটকে পড়া কচ্ছপদের উদ্ধার করাও তার কাজের মধ্যেই পড়ে। এসবের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কচ্ছপ সংরক্ষণ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে এবং শিকার আটকানোর জন্য রীতিমতো প্রচারও চালান কসমে এবং তাঁর স্ত্রী। 

বিগত দেড় দশকে তাঁর এই প্রচেষ্টা রীতিমতো বদলে দিয়েছে ‘কিনো বে’-র বাস্তুতন্ত্রকে। এক-সময় যেখানে গোটা বছরজুড়ে ৩০-৪০টি নতুন কচ্ছপের সন্ধান মিলত এই অঞ্চলে। সেখানে আজ সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০-১৪০-এ। ফলে, প্রজনন ও বংশবিস্তারের জন্য প্রতিবছর আগের তুলনায় প্রায় ৪ গুণ বেশি কচ্ছপ আশ্রয় নিচ্ছে কিনো বে উপকূলে। যা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় এই পরিবেশকে বর্তমানে বেশি সুরক্ষিত বলে মনে করছে সামুদ্রিক কচ্ছপরা। পাশাপাশি কচ্ছপের শিকার হ্রাস পাওয়ায়, বৃদ্ধি পেয়েছে সদ্যোজাত কচ্ছপের সংখ্যাও। ক্রমশ ভারসাম্য ফিরছে বাস্তুতন্ত্রে। 

তবে এখানেই থেমে নেই কসমে। তাঁর অবর্তমানে যাতে এই কাজ আগামী প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা চালিয়ে যেতে পারেন, তারও ব্যবস্থা করে রাখছেন তিনি। প্রতি বছর গড়ে ৩০ জন তরুণ-তরুণীকে কচ্ছপ সংরক্ষণ ও নথি সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। নিজের নৌকায় করে নিয়ে যায় সমুদ্রে, বুঝিয়ে দেন সমগ্র কার্যকলাপ। তাঁর কথায়, একটা সময় কচ্ছপরাই ভাত জুগিয়েছে স্থানীয়দের। অর্থসংকটের সময় হয়ে উঠেছে ত্রাতা। এবার তাঁদের সেই ঋণ ফিরিয়ে দিতে হবে স্থানীয়দেরই। কচ্ছপ সংরক্ষণে এই অনস্বীকার্য অবদানের জন্য ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সিওএনএএনপি-র ‘কনজারভেশন অফ নেচার’ পুরস্কারও পেয়েছেন ষাটোর্ধ্ব মৎস্যজীবী। সবমিলিয়ে কসমে যেন মনে করিয়ে দেন, দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনিকেই।

Powered by Froala Editor