‘বাড়ির মেয়েরা না থাকলে আমরা এই লাইনে থাকতেই পারতাম না। সেই সময়ে মা-ঠাকুমাদের সমর্থন যে কতটা জরুরি ছিল, এখন বুঝতে পারি...’
বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল অঞ্জন বোসের। হ্যাঁ, সেই অঞ্জন বোস। প্রবাদপ্রতিম প্রযোজক এবং ‘অরোরা সিনেমা’র কর্ণধার। কয়েক পুরুষের ব্যবসার উত্তরাধিকার অরোরার চাবিকাঠি এখন তাঁর হাতেই। কিংবদন্তি তো তিনি নিজেও। তাঁর পাশেই বসে ছিলেন অভিনেত্রী কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলছিলেন, ‘আমি আসলে একা থাকতে ভালোবাসি। শুটিং ফ্লোরের ভিড়ের মাঝে আমি একটা ছোট্ট আশ্রয় খুঁজি। বই-এ বুঁদ হয়ে যাই। অরোরাতে গেলে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হত। মনে হত, পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ছবি বিশ্বাস। এককালে এখানেই প্রিমিয়ার করে গিয়েছেন পাহাড়ি সান্যাল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত জানেন!’
গতকাল, ৯ই অক্টোবর গড়িয়াহাটের ট্রাইব ক্যাফেতে উদ্বোধন হল তাঁদের নতুন পুজোর মেনু। সেই উপলক্ষেই হয়ে গেল একটি ঘরোয়া আড্ডা। ছিলেন, অভিনেত্রী কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোদশিল্পী পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রযোজক অঞ্জন বোস, এবং বিশিষ্ট সংগ্রাহক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
গড়পড়তা ক্যাফের তুলনায় ট্রাইব একটু আলাদা। তিনজন বাঙালির হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানের শেকড়ে বাঙালিয়ানা লুকিয়ে। ক্যাফেতে সাজানো সত্যজিৎ-এর নানা সিনেমার পোস্টার। কফি মগেও সাবিকিয়ানার ছায়া। দেওয়ালের তাক থেকে কেউ আলগোছে তুলে নিচ্ছেন স্প্যানিশ গিটার। কফির মাগে চুমুক দিতে দিতে টুংটাং সুর তুলছেন…
তবে ট্রাইবের এই নতুন মেনু সত্যিই অভিনব। প্রত্যেকটা খাবারের কম্বোর নাম বাংলা সিনেমার আইকনিক কোনো জুটির নামে। কোনোটি অপু-দুর্গা, কোনোটি ফেলু-তোপসে। মেনুকার্ডটি হাতে নিলেও চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। বাংলা সিনেমার প্রতি এমন ভালবাসা হয়তো কোনো ক্যাফের মেনুকার্ডে মিলবে না।
‘নয় নয় করে একশো বছর পেরিয়ে গেল ছায়াছবি জগৎ। স্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছে কত যে নাম...দাদাসাহেব ফালকের আগেও প্রায় ৪০টি ছবি পরিচালনা করেছিলেন এক বাঙালি। হীরালাল সেন। তাঁর নাম আজ কেউ জানে না। এই মেনুর মাধ্যমে সেই মানুষগুলিকেই ট্রিবিউত দেবার চেষ্টা করছি আমরা’ বলছিলেন ট্রাইবের একজন পরিচালক, সঞ্জয়বাবু।
অনিন্দ্যবাবু আর চন্দ্রনাথবাবুর কথায় উঠে এল পুরোনো ক্যাফেগুলিও। সিনেমা আর ক্যাফের সম্পর্ক তো চিরদিনের। আর বাঙালিরা চিরকেলে খাদ্যারসিক। চন্দ্রনাথবাবু হারিয়ে যাচ্ছিলেন ‘ডবল হাপ চায়ে’, অনিন্দ্যবাবু তুলনা টানলেন কলকাতাইয়া আড্ডাবাজদের সঙ্গে ফরাসি ক্যাফে কালচারের।
আড্ডা চলতে চলতে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে ক্রমশ। শেষে একসময় দরজা ঠেলে বেরোতেই হয়। কানে বাজতে থাকে অনিন্দ্যবাবুর রসিকতা, “আমরা তো প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ‘ট্রাইবে'র অংশ। কেউ সিনেমা, কেউ বাজনা, কেউ বা প্রয়োজনা। কিন্তু বিবিধের মাঝে একমাত্র পেটপুজোই মিলিয়ে দিতে পারে বাঙালিকে…”
বুঝতে পারি, এবার পুজোয় ফিরতেই হবে ট্রাইবে। নইলে রসনার সাধন হবে না।
Powered by Froala Editor