বুলেট তৈরির যন্ত্রে ক্যান্ডি উৎপাদন, শান্তির বার্তা লুকিয়ে ইতিহাসেই

‘এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়
দিন বদলায় না!’

বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই কয়েকটি লাইনের মধ্যেই ধরা আছে কঠোর বাস্তবের ছবি। যুদ্ধ সর্বশক্তিমানকেও উপড়ে ফেলতে পারে সিংহাসন থেকে, বদলে দিতে পারে দেশের সীমা। কিন্তু যুদ্ধের কি আদৌ শেষ আছে কোনো? যুদ্ধের নেশা আজও ছাড়তে পারেনি মানুষ। আর ক্ষমতাবদল, দখলদারির এই লড়াই-এ, রাজায়-রাজায় যুদ্ধে কেবলমাত্র উলুখাগড়া হয়েই প্রাণ দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। কিন্তু যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদনই যদি বন্ধ হয়ে যায় গোটা বিশ্বজুড়ে, তাহলেও কি নিয়ন্ত্রণে আসবে না পরিস্থিতি? 

আজ থেকে ৭৫ বছর আগের কথা। এই ভাবনা থেকেই যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের কারখানা বন্ধ করে ক্যান্ডির উৎপাদন শুরু করেছিলেন এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী— এডওয়ার্ড ডি (Edward Dee)। যাঁরা দেশ-বিদেশের চকোলেট, ক্যান্ডির সন্ধান রাখেন, তাঁদের কাছে ‘স্মার্টিস’ (Smarties) নামটি অতিপরিচিত। আর আমাদের গল্পের নায়ক এডওয়ার্ড ডি এই খ্যাতনামা মার্কিন ক্যান্ডি ও চকোলেট প্রস্তুতকারক সংস্থারই প্রতিষ্ঠাতা। 

শুরু থেকেই বলা যাক। ১৯২২ সালে ইংল্যান্ডের লন্ডনে জন্ম এডওয়ার্ডের। পড়াশোনা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে যে-সময়ে কলেজে ভর্তি হন তিনি, তখন ইউরোপ-জুড়ে বেজে উঠেছে বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কা। নাৎসি জার্মানির তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ব্রিটেন। নাৎসিদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র ও কার্তুজেরও অভাব যথেষ্ট। ফলে ব্রিটিশরা সে-সময় বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া শুরু করে ওয়ার-ইঞ্জিনিয়ারিং বা যুদ্ধ-প্রযুক্তিকে। শুরু হয় নানান গবেষণা। সেইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুলে যায় যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের কারখানা। 

এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অন্যতম শরিক ছিলেন এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড তৈরি করে ফেলেন প্যালেট তৈরির এক বিশেষ যন্ত্র। বুলেট অর্থাৎ গুলির মধ্যে বারুদ ভরে হাইড্রোলিক প্রেসের মাধ্যমে তার মুখ বন্ধ করে দিত এই যন্ত্র। তাতে অনেকটাই বৃদ্ধি পায় বুলেট উৎপাদনের হার। তরুণ এডওয়ার্ডের এই উদ্ভাবনী যে যুদ্ধে পরোক্ষভাবে একটা বড়ো প্রভাব ফেলেছিল তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে যুদ্ধের শেষে এডওয়ার্ড উপলব্ধি করেন, কাতারে কাতারে মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তাঁরই তৈরি যুদ্ধাস্ত্রের কারণে। তবে যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি অবাক করে এডওয়ার্ডকে, তা হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও এতটুকু চাহিদা কমেনি যুদ্ধাস্ত্রের। বরং, পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেয় ব্রিটেন। বাড়াতে শুরু করে অস্ত্রের ভাণ্ডার। আবার অন্যদিকে তখন তিক্ততা বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের মধ্যেও। 

এডওয়ার্ড বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধাস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ না করলে এই পরিস্থিতি বদলাবে না কোনোদিনই। আজ না হয় তো কাল ফের বেজে উঠবে যুদ্ধের দামামা। ১৯৪৮ সাল থেকেই বুলেট তৈরির অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দেন এডওয়ার্ড। পরের বছরই আনুষ্ঠানিকভাবে তালা ঝোলান কারখানায়। তারপর প্যালেট তৈরির যন্ত্রগুলি রীতিমতো বগলদাবা করেই পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। না, দেশবদল করে, অন্য রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা বা অস্ত্র তুলে দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর। বরং, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিকল্পনা ফেঁদেছিলেন তিনি। 

বুলেট তৈরির যন্ত্রে হাইড্রোলিক প্রেসের চাপ কমিয়ে বেশ কিছু বদল করেন এডওয়ার্ড। বারুদ ও ধাতব প্যালেটের বদলে সেই ছাঁচে ঢেলে দেন বিভিন্ন স্বাদের ও গন্ধের চিনির মণ্ড। ম্যাজিক খেলে যায় সেখানেই। যুদ্ধাস্ত্র তৈরির এই যন্ত্র চোখের নিমেষে বদলে যায় ক্যান্ডি উৎপাদনকারী মেশিনে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ব্লুমফিল্ডে একটি পরিত্যক্ত অঞ্চল ভাড়া নিয়েই প্রাথমিকভাবে এই অভিনব কারখানা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। অবশ্য তখন পর্যন্ত ‘স্মার্টিস’ নামটির জন্ম হয়নি। শুরুতে এই ক্যান্ডি কোম্পানি পরিচিত ছিল ‘সি ডি ক্যান্ডি’ নামে। পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে নাম বদল করে ‘স্মার্টিস’ হয়ে ওঠে এডওয়ার্ডের এই সংস্থা। আজ যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, গোটা বিশ্বজুড়েই প্রসিদ্ধ ‘স্মার্টিস’-এর ক্যান্ডি, চকোলেট। 

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ক্যান্ডি তৈরির জন্য কেন দেশ ছেড়েছিলেন তিনি? ব্রিটেনে থেকেই কি চালানো যেত না এই ব্যবসা? এডওয়ার্ডের উত্তর ছিল, নিজের দেশে যুদ্ধাস্ত্রের কারখানায় ক্যান্ডি উৎপাদন হয়তো সম্ভব হত না প্রশাসনিক চাপের কারণে। বিশ্বকে শান্তির বার্তা দেওয়াও সম্ভব হত না তাঁর পক্ষে। আর সেই কারণেই দেশত্যাগ। 

২০১৯ সালে ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন এডওয়ার্ড। তবে ‘স্মার্টিস’ আজ পরিণত হয়েছে পারিবারিক ব্যবসায়। তাঁর অবর্তমানে এই ব্যবসার হাল ধরেছেন তাঁর সন্তান, নাতি-নাতনিরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কানাডা ও মেক্সিকোতেও ‘রকেটস’ নামে খুলে তাদের ক্যান্ডি তৈরির কারখানা। তবে জনপ্রিয় তাই চকোলেটের গ্রাহকদের কজনই বা জানেন যে তাঁদের এই প্রিয় ক্যান্ডির সঙ্গেই জড়িয়ে এমন বিচিত্র ইতিহাস। এডওয়ার্ডের এই উদ্যোগ যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় রেশ টানতে পারেনি ঠিকই, তবে তৈরি করেছিল এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। পরবর্তীতে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র এবং পরীক্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ।

Powered by Froala Editor