ব্রিটিশরাজের মুকুট চুরির দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন যে ব্যক্তি!

ঠিক এক বছর আগের কথা। আজকের দিনেই নতুন রাজা পেয়েছিল ব্রিটেন। রাজ্যাভিষেক হয়েছিল কিং চার্লসের। মাথায় উঠেছিল মুকুট (Crown Jewels)। কোহিনূর সংক্রান্ত বিতর্কের কথা সরিয়ে রাখলে, এই মুকুটই নাকি তামাম ব্রিটিশ জনগণের গর্বের প্রতীক। প্রতীক ব্রিটিশ রাজবংশের দম্ভের। তবে আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে এই মুকুট চুরি করে ব্রিটিশ-রাজের দম্ভ ভেঙেছিলেন এক ব্যক্তি। 

হ্যাঁ, শুনতে খানিক আশ্চর্য লাগলেও ব্যাপারটা সত্যি। পৃথিবীর ইতিহাসে কেবলমাত্র একবারই ঘটেছে এমন আশ্চর্য ঘটনা। আর তার নেপথ্যে রয়েছেন ব্রিটেনের ডবল-সিক্রেট এজেন্ট থমাস ব্লাড (Thomas Blood)। 

শুরু থেকেই বলা যাক এই কাহিনি। ক্লেয়ার লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত নথি অনুযায়ী, ১৬১৮ সালে আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি ক্লেয়ারের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ব্লাডের। বাবা ছিলেন সে-যুগের বেশ নামকরা একজন কর্মকার। তাছাড়া দাদা এডমন্ড ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। এমনকি ব্লাড নিজেও কাজ করতেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে। কাজেই সম্পত্তির অভাব ছিল না কোনো। কাউন্টি ক্লেয়ার ছাড়াও কাউন্টি মিথ এবং উইকলোতেও বিস্তর জমিজমা ছিল ব্লাড পরিবারের। 

১৬৪২ সাল। দুই মেরুতে ভাগ হয়ে যায় ব্রিটেনের শাসকগোষ্ঠী। একদিকে রাজা প্রথম চার্লস, অন্যদিকে পার্লামেন্টের সদস্যরা। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। প্রাথমিকভাবে ইংল্যান্ডের রাজার হয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন টমাস ব্লাড। সে-সময় রাজবাহিনীর মেজর তিনি। তবে কিছুদিন যুদ্ধ লড়ার পর নিজেই নিজেকে ‘কর্নেল’ হিসাবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন থমাস। অবশ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এই সুদিন। ক্রমশ রাজার সেনাবাহিনীর ওপর ক্ষমতা কায়েম করতে থাকে পার্লামেন্টের বাহিনী। পরিস্থিতির রদবদল দেখে সে-সময় দল পরিবর্তন করে ফেলেন ব্লাড। রাজার বাহিনী ছেড়ে অংশ হয়ে যান বিপক্ষের। ১৯৫৩ সালে প্রথম চার্লসের পরাজয়ের পর ব্লাডকে জাস্টিস অফ দ্য পিস উপাধি দেয় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। দেওয়া হয় প্রচুর পরিমাণ সম্পত্তিও। 

তবে এতকিছুর পরেও ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি ব্লাডকে। ১৬৬০ সালে সিংহাসনে ফিরে আসেন প্রথম চার্লস। নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ব্লাড তখন থিতু আয়ারল্যান্ডে। চার্লসের প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে ব্লাড ডাবলিন দুর্গ দখলের ডাক দেন। অসন্তুষ্ট ক্রোমওয়েলিয়ানদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাহিনী। তবে ব্লাডের এই চক্রান্ত ব্যর্থ হয় শেষমেশ। ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে হেরে সপরিবারে পালিয়ে যেতে হয় হল্যান্ডে। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডে তাঁর বিপুল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ প্রশাসন। 

বলতে গেলে, এক জীবনে তিলে তিলে গড়ে তোলা সমস্ত সঞ্চয়কেই মুহূর্তের মধ্যে হারাতে হয়েছিল ব্লাডকে। আর এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই রাজার মুকুট চুরির পরিকল্পনা তাঁর। এই কাজ আর পাঁচজন তস্করের কাছে সহজ হলেও, খুব একটা পেগ পেতে হয়নি ব্লাডকে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত থাকায় লন্ডনের আটঘাট জানা ছিল তাঁর। ফলে বছর দশেক পর চেনা সূত্র কাজে লাগিয়ে, নিজের নাম বদলে ফের লন্ডনে ফিরে আসেন তিনি। পূর্ব লন্ডনের রমফোর্ডের একজন ডাক্তারের কাছে ওষুধ নির্মাতা হিসাবে শুরু করেন অনুশীলন। এমনকি এই ডাক্তারখানাতেই তৈরি হয়েছিল মুকুট-চুরির পরিকল্পনা। 

আজকের মতোই সে-সময় লন্ডনের কিংবদন্তি লন্ডন টাওয়ারেই রাখা থাকত ক্রাউন জুয়েল তথা রাজমুকুট। কেবলমাত্র রাজ্যাভিষেক কিংবা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানেই তা মাথায় পরতেন রাজা। বছরের অন্যান্য দিন তা প্রদর্শিত হত সাধারণ মানুষের জন্য। 

লন্ডন টাওয়ারে সে-সময় এই মুকুট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল প্রথম চার্লসের বিশ্বস্ত প্রবীণ প্রহরী ট্যালবট এডওয়ার্ডসের হাতে। লন্ডন টাওয়ারেরই বেসমেন্টে সপরিবারে থাকতেন তিনি। বলার অপেক্ষা থাকে না, মুকুটের নাগাল পেতে এডওয়ার্ডসকে বশে আনার পরিকল্পনা করেন ব্লাড। নানা অছিলায় এডওয়ার্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান তিইনি। তারপর নিজের ছেলেকে ভাগ্নে সাজিয়ে এডওয়ার্ডসের কন্যার জন্য বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে আসেন তিনি। 

দিনটা ৯ মে। ১৬৭১ সাল। নিজের সন্তানকে ভাগ্নে সাজিয়ে লন্ডন টাওয়ারে হাজির হন ব্লাড। সঙ্গে নেন অবসরপ্রাপ্ত আরও এক শক্তসামর্থ্য সেনাকে। লন্ডন টাওয়ারে প্রবেশের পর আচমকাই এডওয়ার্ডসের ওপর হামলা করে বসেন তিনজন। ছুরিকাঘাতে এডওয়ার্ডসকে জখম করে বেঁধে ফেলেন দড়ি দিয়ে। তারপর হাতুড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে ফেলা হয় মুকুটের রত্নগুলি। অন্যদিকে মুকুটের মূল কাঠামো দুমড়ে-মুচড়ে ঢুকিয়ে ফেলা হয় ব্যাগে। তবে পালাবার আগেই ঘটে যায় বিপত্তি। লন্ডন টাওয়ারে বেজে ওঠা সাইরেন। আসলে ধাতব আওয়াজ শুনে বিপদের আন্দাজ করেছিলেন খোদ এডওয়ার্ডসের কন্যা। বাবাকে বন্দি অবস্থায় দেখে তিনিই সাইরেন বাজান দুর্গের। 

না, মুকুট চুরি করলেও আর পালিয়ে যেতে পারেননি ব্লাড। দুর্গের ফটকেই ধরা পড়ে যান তিনি। বন্দি করা হয় তিনজনকেই। দণ্ডিত করা হয় মৃত্যুদণ্ডে। তবে এবারেও ফের বুদ্ধি কাজে লাগিয়েই নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন ব্লাড। বিচারকের সামনে কোনো মন্তব্যই করেননি তিনি। কেবলমাত্র শেষ ইচ্ছে হিসাবে জানিয়েছিলেন, খোদ ব্রিটিশরাজ চার্লসের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চান তিনি। 

হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত রাজার সামনেই হাজির করা হয়েছিল তাঁকে। আর সেখানেই রাজার কানে আশ্চর্য সব তথ্য দিয়েই নিজেকে মুক্ত করেন ব্লাড। এমনকি এর পর ফের ব্রিটেনের সিক্রেট এজেন্ট হিসাবে নিয়োগ করা হয় তাঁকে। প্রতি মাসে ৩০০ পাউন্ড করে পেতেন ব্লাড। ফিরে পেয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডের সম্পত্তিও। কিন্তু রাজার কানে কানে কী বলেছিলেন তিনি?

সে-কথা রহস্য হয়ে রয়ে গেছে আজও। অবশ্য গোয়েন্দা হিসাবে যে মন্দ ছিলেন না ব্লাড, তা প্রমাণিত হয়ে যায় এই ঘটনা থেকেই। তবে এতকিছুর পরও বদমেজাজ বদলায়নি ব্লাডের। ১৬৭৯ সালে ডিউক অফ বাকিংহামের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য ফের একবছরের জন্য কারাবন্দি হন তিনি। এমনকি অপমানজনক মন্তব্যের জন্য ১০ হাজার পাউন্ড জরিমানাও দিতে হয়েছিল তাঁকে। ১৬৮০ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পেলেও, অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কারামুক্তির কয়েকদিনের মাথায় প্রয়াত হন ৬২ বছর বয়সে। তারপর কেটে গেছে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর। তবে আজও রাজার মুকুট চুরির দুঃসাহস দেখাননি আর দ্বিতীয় কেউ। সে-ক্ষেত্রে আজও অদ্বিতীয় হয়ে রয়েছেন থমাস ব্লাড। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More