সবেমাত্র প্যারিসের অরলে বন্দরের রানওয়ে ছুঁয়েছে পাকিস্তানের বোয়িং ৭২০বি বিমান। এবার নামতে হবে। লাইন দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ইমিগ্রেসন কাউন্টারের দিকে। ২৫ জন যাত্রী তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বিমানের ৬ জন কর্মীও শেষ মুহূর্তের কাজ সামলে নিতে ব্যস্ত। আর ঠিক এই সময়েই বিমানে উঠে পড়লেন ২৮ বছরের এক যুবক। একহাতে পিস্তল, অন্য হাতে একটি ব্যাগ। দেখে মনে হয় তার মধ্যে কোনো বিস্ফোরক রাখা আছে। যাত্রীরা ভয়ে কাঠ। পাইলটের হাত দিয়ে নিজের দাবিপত্র বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিলেন আততায়ী। পুলিশ ছুটে এল। কিন্তু আততায়ীর অব্যর্থ নিশানা তাঁকে মেরে ফেলল না ঠিকই, তবে ভয়ানক জখম করল। যদিও যাত্রী এবং বিমানকর্মীদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
দিনটা ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ঠিক সেইদিনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে পাক বাহিনীর। তখন বাংলাদেশের অসংখ্য বস্তিতে, ভারতের বুকে অসংখ্য শরণার্থী শিবিরে কোনোক্রমে বেঁচে আছেন অসংখ্য বাঙালি। প্রায় সারা দেশ ঘিরে ফেলেছে রাজাকার এবং পাক বাহিনী। শিবিরে শিবিরে ছড়িয়ে পড়েছে কলেরা, টাইফয়েড। প্রায় এক মহামারীর চেহারা নিয়েছে। আর ঠিক সেইদিনই এক আলাদা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন এক ফরাসি যুবক। জাঁ কাই। এর আগে কিছুদিন ফ্রান্সের সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিনি। কিন্তু এবারের লড়াই তাঁর একার।
সেদিনই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিদাউয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট। অরলে বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষীদের তাই অন্য কোনোদিকে তাকানোর সুযোগ নেই। ফলে পাকিস্তানের বিমানের দিকে অতি সহজেই এগিয়ে যেতে পারলেন জাঁ কাই। কিন্তু কেন? কী উদ্দেশ্য এই অভিযানের? তার উত্তর ছিল জাঁ কাইয়ের দাবিপত্রে। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, অবিলম্বে যাত্রীদের নামিয়ে নিতে। আর তারপর তিনি এই বিমান অপহরণ করে নিয়ে যাবেন। আকাশের বুকে ভেসে সোজা চলে যাবেন বাংলাদেশ। কারণ এই জাহাজের ডিকিতেই আছে ২০ টন ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম। পাকিস্তান থেকেই ফ্রান্সে এসেছে এইসমস্ত ওষুধ। অন্যদিকে ওষুধের অভাবে রোজ রোজ মারা যাচ্ছেন অসংখ্য বাঙালি শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কাই তাঁদের কাছে এই ওষুধ পৌঁছে দেবেন।
যদিও একা একটি পিস্তলকে হাতিয়ার করে বেশিক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারলেন না জাঁ কাই। সকাল ১১:৫০-এ বিমান অপহরণের চেষ্টা করেন তিনি। আর সেদিন বিকেলের মধ্যেই অবশেষে পুলিশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন কাই। আদালতে বিচার শুরু হল। পুলিশ এভিডেন্স দিতে গিয়ে আবারও অবাক। যে ব্যাগে বিস্ফোরক আছে বলে সন্দেহ করেছিলেন তাঁরা, সেখান থেকে বেরোল একটি বাইবেল এবং দুটি ডিকশনারি। বাংলাদেশে এসে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এই ডিকশনারি কাজে লাগত। জাঁ কাইয়ের সাহসিকতা দেশে অবাক হয়েছিল সারা বিশ্ব। আর অবাক হয়েছিল বহুদূরে বাংলাদেশের অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা দেখে।
বিচারে শেষ পর্যন্ত অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে একজন মানবতাবাদী নায়ক হিসাবেই মনে রেখেছে ইতিহাস। আর তাঁর দাবি মেনেই সেই ২০ টন ওষুধ বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন ফ্রান্স সরকার। প্রত্যেকের কাছে সেই ওষুধ বণ্টনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ফ্রান্সের রেডক্রস সোসাইটি। ৫ বছরের কারাবাসের মেয়াদ শেষে যেদিন মুক্তি পেলেন জাঁ কাই, সেদিন আবারও প্যারিসের রাজপথে ভেঙে পড়েছিল মানুষের ভিড়। আর ২০১২ সালে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভারত, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট-ইন্ডিজের অসহায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ইতিহাসে সত্যিই এক ব্যতিক্রমী নায়ক তিনি।
তথ্যসূত্রঃ
Paris Police Thwart Airliner Hijacking, Henry Kamm, The New York Times
Salute to Jean Kay, the friend of the distressed, Lt. Col. (Retd.) Quazi Sajjad Ali Zahir, The Daily Star
আরও পড়ুন
বাঙালির প্রযুক্তিতে বাজিমাত, কলকাতায় অঞ্চলভেদে দূষণের মাত্রা জানাবে নয়া যন্ত্র
Powered by Froala Editor