“ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কখনও মনে লক্ষ্যমাত্রা রাখতে নেই। আমরা আগে থেকেই ধরে নিই, পাঁচদিন বা সাত দিনের মধ্যেই কোনো জায়গা ঘুরতে হবে, মাস খানেকের মধ্যেই ভারতভ্রমণ শেষ করতে হবে। এভাবে ঘোরা গেলেও, খুশি হওয়া যায় না। বরং, কোনো জায়গায় যদি মন থেকে ভালো লাগে, যেখানে অনায়াসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় বেশ কিছুদিন…”
বলছিলেন দিল্লিনিবাসী আফসার মালিক (Afsaar Malik)। অবশ্য যখন তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছে, তিনি তখন কলকাতায়। ব্যস্ততার ছাপ ফুটে উঠছিল তাঁর বাচনে। ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে তখন তিনি পাড়ি জমাচ্ছেন দার্জিলিং-এর পথে।
ঘুরতে যেতে কার না ভালোলাগে? একদম ছোটো থেকেই দেশ-বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন লালন করতে শিখি আমরা। তারপর যত বয়স বাড়ে ধীরে ধীরে, কোথাও গিয়ে যেন সেই স্বপ্নই বোঝা হয়ে দাঁড়ায় অনেকের কাছে। বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাজেট। সত্যিই তো, ঘুরতে যাব বললেই তো আর বেরিয়ে পড়া যায় না। প্রয়োজন পড়ে অর্থের। কিন্তু নিখরচায় যদি ঘুরে দেখা যেত গোটা বিশ্ব?
হ্যাঁ, এমনটাই সত্যি করে দেখিয়েছেন আফসার। তাঁর গল্পটা, এই অনবদ্য জার্নি অনেকের কাছেই সাক্ষাৎ ইউটোপিয়া। বিগত দু’বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেছেন তিনি। তবে কোনো অর্থেই প্রয়োজন পড়েনি তাঁর। তাহলে খাওয়া, থাকা, যাতায়াতের খরচ? “থাকা, খাওয়া আর পরিবহন— শুধু এই তিনটি জিনিসের বন্দোবস্ত করলেই ঘুরতে পারা যায়। থাকার জন্য প্রথমে ক্যাম্পিং টেন্ট নিয়ে যেতাম আমি। কখনও গুরুদ্বারেও রাত কাটিয়েছি। খাবারের জন্য প্রথমে স্বল্প কিছু টাকা নিজের কাছে রাখতাম। এখন সেটারও প্রয়োজন পড়ে না। স্থানীয়রা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন”, জানালেন আফসার।
ব্যাকপ্যাকে লাগানো কার্ডবোর্ডের ছোট্ট একটি পোস্টারই আফসারের পরিচয়। তাতে লেখা থাকে ‘ট্রাভেলিং উইদআউট মানি’। বিগত দু’বছরে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইউটিউবে যথেষ্ট পরিচিতও পেয়েছেন আফসার। আর তাঁর এই পোস্টারই হয়ে উঠেছে ট্রেড মার্ক। এই ছোট্ট পোস্টারের সৌজন্যে, অনায়াসেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার লিভ পেয়ে যান তিনি।
মনে মনে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, বিনামূল্যে পর্যটন তো হল, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন চলে কীভাবে? পিছিয়ে যাওয়া যাক আরও কয়েকটা বছর। ২০২০ সালের মে মাসের কথা। তখন ভারতজুড়ে লকডাউন। আফসার সে-সময় দিল্লির একটি সংস্থায় অ্যাকাউন্ট্যান্টের পদে কর্মরত। দমবন্ধ করা পরিবেশ, গৃহবন্দিদশা, তার মধ্যেও কাজের ব্যস্ততা— এই সবকিছুর মধ্যেই হাঁফিয়ে উঠেছিলেন আফসার। ভারতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু চাকরি থেকে কি ছুটি মিলবে সহজে? অগত্যা, পদত্যাগপত্র। সঙ্গী করেন সামান্য কিছু অর্থ, জামাকাপড়, স্লিপিং ব্যাগ, তাঁবু আর ক্যামেরাকে। আফসারের কথায়, “যে-কারোর কাছেই চাকরি ছেড়ে দেওয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের জীবন চালানোর মতো প্রচুর কাজ রয়েছে ভারতে। আমি ভেবেছিলাম পরবর্তীতে আবার কর্মজীবনে ফেরার প্রয়োজন পড়লে, তেমনই কোনো কাজ জুটিয়ে নেব।”
না, আজ আফসারের আর সেই চাকরির প্রয়োজন নেই কোনো। ইউটিউব এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট সাড়া পেয়েছেন তিনি। আজ ভারতের জনপ্রিয় ভ্লগারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জানালেন, সেটাই হয়ে উঠেছে এখন তাঁর জীবিকা নির্বাহের পথ।
বিগত দু’বছরে হিমাচল, গোয়া, তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ড, লাদাখ, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে ঘুরেছেন আফসার। এবার ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বভ্রমণের পথে হাঁটতে চলেছেন তিনি। আর কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরই তিনি উড়ে যাবেন থাইল্যান্ড। সেটাও হচ্ছে ন্যূনতম খরচাতেই। আফসারের কথায়, “ভারতের মতো যেখানে সেখানে ক্যাম্পিং করে থাকা যায় না থাইল্যান্ডে। তবে দিনে ১০০ টাকা মূল্যে হস্টেল পাওয়া যায়। থাকব সেখানেই। খাওয়া-দাওয়া ও স্থানীয় পরিবহনের খরচাও লাগবে না সেভাবে।” খরচ বলতে শুধুমাত্র বিমানের টিকিট। “প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ছিল, আকাশপথে না গিয়ে, ভারতের সীমান্ত পেরিয়েই পাড়ি দেব থাইল্যান্ডে। কিন্তু মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যই এই পথ বেছে নিতে হল।”থাইল্যান্ড ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, লাওস ও কম্বোডিয়ায় ঘুরবেন আফসার। তবে দেখতে গেলে এটাই তাঁর প্রথম বিশ্বভ্রমণ নয়। এর আগে নেপাল ঘুরে ফেলেছেন তিনি। অবশ্য সেখানে যেতে যে পাসপোর্ট প্রয়োজন হয় না, তা খানিক হেসে জানালেন দিল্লির যুবক।
বিশ্বভ্রমণ বা ভারতভ্রমণের স্বপ্ন আমরা সকলেই কম-বেশি লালন করি নিজের মনে। কিন্তু ক’জনই বা অর্থের চিন্তা কাটিয়ে নেমে পড়তে পারি রাস্তায়? খুব সহজেই আমরা হার স্বীকার করে নিই অনিশ্চয়তার কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আফসার প্রমাণ করে দেখাচ্ছেন, ইচ্ছে থাকলেই অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব। এমন সাহসিকতা কুর্নিশযোগ্য তো বটেই…
Powered by Froala Editor