রাত জাগার অভ্যেস আছে অনেকেরই। কিন্তু একটানা দু-তিনদিন ঘুম না হলে, ঝিমিয়ে পড়ে শরীর। এমনকি শারীরিক ঘড়ির স্বাভাবিক ছন্দের হঠাৎ এই রদবদলের কারণে অসুস্থও হয়ে পড়তে পারেন মানুষ। কিন্তু একটানা যদি ১১ দিন না-ঘুমিয়ে থাকা হয়?
হ্যাঁ, শুনতে অস্বাভাবিক লাগলেও সত্যি। ১৯৬৪ সালে এমনই এক আশ্চর্য বিশ্বরেকর্ড গড়েন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা র্যান্ডি গার্ডনার (Randy Gardner)। ক্যালিফোর্নিয়ার (California) সান দিয়েগো ১৭ বছর বয়সি এই কিশোর একটানা জেগে ছিলেন ২৬৪ ঘণ্টা। নাম তুলেছিলেন গিনেস বুকে। তাঁর তৈরি সেই রেকর্ড অক্ষত রয়েছে আজও। তবে প্রাথমিকভাবে এই রেকর্ড তৈরি করে দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিলেও, মাশুল গুনতে হয়েছিল তাঁকে।
শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। গার্ডনার ক্যালিফোর্নিয়ার পয়েন্ট লোমা হাই স্কুলের ছাত্র। আর এই স্কুল থেকেই সূত্রপাত এই ঘটনার। সে-বছর প্রথমবারের জন্য বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের এই স্কুল। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ বিশেষ মডেল তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।
দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এই মেলায় অংশ নিয়েছিলেন গার্ডনার ও তাঁর দুই বন্ধু ব্রুস এবং জো। না, কোনো মডেল তৈরির পথে যাননি তাঁরা। বরং, সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান মেলায় এক আশ্চর্য পরীক্ষা করার কথা ভাবেন গার্ডনার। কী সেই পরীক্ষা? সে-সময় তখন যুক্তরাষ্ট্র-জুড়ে চর্চা চলছে ‘স্লিপ ডেপ্রিভেশন’ এবং ‘ইনসোমনিয়া’ নিয়ে। কারোর মতে, ঘুম না হলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে গুরুতরভাবে। আবার কোনো গবেষকের মতে, নিদ্রাহীনতার কারণে তৈরি পারে শারীরিক সমস্যা। এমনকি হতে পারে মৃত্যুও। তবে তখনও নির্দিষ্টভাবে তার প্রমাণ মেলেনি কোনো। র্যান্ডি ও তাঁর বন্ধুরা ঠিক করেন এই বিষয়টি নিয়েই পরীক্ষা চালাবেন তাঁরা। না-ঘুমিয়ে তৈরি করবেন বিশ্বরেকর্ড। ঠিক হয়, তিন বন্ধুর মধ্যে একটানা জেগে থাকবেন গার্ডনার। অন্যদিকে জো এবং ব্রুস নথিভুক্ত করবেন সময়ের সঙ্গে কী কী পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে গার্ডনারের দেহে।
গার্ডনার ও তাঁদের বন্ধুদের এই আশ্চর্য পরীক্ষার কথা প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন একাধিক সংবাদপত্রেও। সাড়া পড়ে গিয়েছিল স্থানীয়দের মধ্যে। ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক উইলিয়াম ডিমেন্টেরও। উইলিয়াম যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলেন। গার্ডনার, ব্রুস ও জো-এর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন তিনি। জানান, পরীক্ষাকালীন সময়ে স্বয়ং হাজির থাকবেন তিনি এবং তাঁর সহকারী কর্মীরা। সাগ্রহে রাজি হয়ে যান তিন বন্ধু। এমনকি উইলিয়ামের উপস্থিতিতে খানিক আশ্বস্তও হয়েছিলেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
হ্যাঁ, আশ্বস্তও হওয়াই বটে। এই পরীক্ষা নিয়ে আশঙ্কার মেঘ দেখা দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের মধ্যেও। তার কারণ, এর আগে এই একই পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল বিড়ালের ওপরও। একটানা ১৫ দিন ওষুধ প্রয়োগ করে জাগিয়ে রাখা হয়েছিল একাধিক বিড়ালকে। তবে ১৫ দিনের পরই মৃত্যু হয় বিড়ালগুলির। কাজেই র্যান্ডি ও তাঁর বন্ধুদের পরীক্ষা নিয়েও কেগে ছিল সেই সম্ভাবনা। এক্ষেত্রে উইলিয়ামই নিশ্চিত করেন, না-ঘুমিয়ে থাকার ক্ষেত্রে ডেক্সিড্রিন, বেনজিড্রিন-জাতীয় কোনো উদ্দীপক ওষুধ যেন না ব্যবহৃত হয়।
না, প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি কোনো। তবে একেবারে নিরঞ্ঝাটে সম্পন্ন হয়নি এই পরীক্ষা। তিনদিনের পর থেকেই সজ্ঞান থাকার ক্ষমতায় ধীরে ধীরে প্রভাব পড়তে থাকে র্যান্ডির ওপর। গন্ধ, স্বাদ এমনকি শ্রবণশক্তিতেও প্রভাব পড়ে র্যান্ডির। অর্থাৎ, ক্ষমতা হারাতে শুরু করে তাঁর পঞ্চ-ইন্দ্রিয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, না-ঘুমিয়েও সে-সময় বাস্কেটবল খেলেছেন তিনি। প্রথমদিকে রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে সেরকম বড় কোন শারীরিক অসুবিধা হয়নি তাঁর। তবে পরবর্তীতে ক্রমশ শারীরিক দুর্বলতা বাড়তে থাকে র্যান্ডির। যার ফলস্বরূপ ২৬৪ ঘণ্টা অর্থাৎ ১১ দিনের মাথায় রণে ভঙ্গ দিতে হয় তাঁকে। অবশ্য ততদিনে না-ঘুমিয়ে বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছেন তিনি। নাম তুলেছেন গিনেস বুকের পাতায়। কিন্তু তারপর?
এরপর একটানা ১৪ দিন ঘুমিয়েছিলেন র্যান্ডি। পাশাপাশি শুরু হয় ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ বা রেম। অর্থাৎ, ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সময় অক্ষিগোলকের অস্বাভাবিক গতিবিধি। অন্যদিকে এই দীর্ঘ ঘুমের পর সজ্ঞানে ফিরলেও আর স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারেননি তিনি। শিকার হন ইনসোমনিয়ার। ৭০-র পেরিয়ে আজ এই আশ্চর্য পরীক্ষার জন্য নিজেই দুঃখপ্রকাশ করেন র্যান্ডি।
অবশ্য এই পরীক্ষা তাঁর জীবনের অন্যতম বড়ো ‘ভুল’ হয়ে থাকলেও, নতুন দিগন্তের হদিশ দিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। খুলে দিয়েছিল নতুন দরজা। গবেষক উইলিয়াম ডিমেন্ট নিজেই প্রকাশ করেছিলেন একাধিক গবেষণাপত্র। যা আজই প্রামাণ্য বলে ধরে নেওয়া হয় ইনসোমনিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে। এমনকি বিনিদ্রার গবেষণার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলেই বিবেচনা করা হয় তাঁকে। সবমিলিয়ে এই আশ্চর্য পরীক্ষার জন্য মাশুল দিতে হলেও, সম্পূর্ণ বৃথা যায়নি র্যান্ডির এই উদ্যোগ।
Powered by Froala Editor