৩০০০ বার বিক্রি করেছেন ব্রুকলিন ব্রিজ, রেহাই পায়নি স্ট্যাচু অব লিবার্টিও!

ধরুন, কলকাতার ফুটপাত ধরে আপনি হাঁটছেন। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, ‘আপনি কি একটি ব্রিজ কিনতে চান?’ এক মুহূর্তে চমকে তাকাবেন সেই মানুষটির দিকে। কোন ব্রিজ? নাম শুনে আরও এক প্রস্থ ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। ‘হাওড়া ব্রিজ’। এই ব্রিজ এমনভাবেও বিক্রি করা যায়? এসব অবশ্য কাল্পনিক। কলকাতা হয়তো এমন ঘটনার সাক্ষী থাকেনি। কিন্তু আমেরিকার কাছে এই ঘটনা মোটেও গল্পকথা নয়। একটা সময় সত্যি সত্যি সেখানে এমনটা ঘটেছিল; ‘বিক্রি’ হয়েছিল নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ব্রুকলিন ব্রিজ। কে করেছিল এমন অসাধ্য সাধন? 

উনবিংশ শতকের শেষের দিক। নিউ ইয়র্কের বুকে বেড়ে উঠছে এক আইরিশ যুবক, নাম জর্জ সি পার্কার। নিজের দেশ থেকে আমেরিকায় চলে এসেছিল তাঁর পরিবার। তারপর এখানেই বেড়ে ওঠা, এখানেই জন্ম জর্জের। ছোটো থেকেই ধুরন্ধর, তীক্ষ্ণ চোখে খেলে যাচ্ছে অদৃশ্য বুদ্ধির ঢেউ। অচিরেই নিজের এমন ‘ট্যালেন্ট’কে চিনে ফেললেন জর্জ। আর সেই বুদ্ধিই হয়ে ওঠে তাঁর হাতিয়ার। শুরু হয় আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বড়ো ‘কন ম্যান’-এর কাহিনি… 

উনবিংশ শতকেরই আশির দশকের কথা। নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন একজন। হঠাৎই তাঁর কাছে হাজির হল কোট-টাই পরিহিত এক যুবক। দেখে মনে হচ্ছে বেশ সম্ভ্রান্ত। প্রাথমিক পরিচিতির পর যুবকটি ওই লোকটিকে বলল, ‘আমি এই ব্রুকলিন ব্রিজের আসল মালিক। এই ব্রিজটি আপনাকে বিক্রি করতে চাই।’ এমন কথা শুনে যে কোনো মানুষেরই ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তাও ব্রুকলিন ব্রিজের মতো একটা ঐতিহাসিক, হেরিটেজ একটি স্থাপত্য! এখানেই ছিল ওই যুবক, অর্থাৎ জর্জ সি পার্কারের কেরামতি। ঠিক কারা কারা তাঁর এমন ‘প্ল্যান’-এর শরিক হবেন, বুঝে যেতেন সহজাত প্রতিভায়। যাঁদের কাছে বলতেন, অদ্ভুতভাবে তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বাসও করে নিতেন একটা সময়। তারপর এই মানুষগুলোই যখন কিছু অবৈধ কাজ করতে যেতেন, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে ধরা পড়তেন। আর বেঁচে যেতেন জর্জ পার্কার। 

যতবারই লোকের সঙ্গে কথা বলতেন, কখনই নিজের আসল পরিচয় দিতেন না। আর পুরো পরিকল্পনার পিছনে ছিল নানা অদ্ভুত ও মিথ্যে ‘পরিশ্রম’। কখনও ভুয়ো পরিচয় প্রমাণ করার জন্য ডকুমেন্ট তৈরি, কখনও ভুয়ো অফিস— সবকিছুই করা হত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। একবার, দুবার নয়; প্রায় তিন হাজার বার ব্রুকলিন ব্রিজ বিক্রি করেছেন জর্জ সি পার্কার। পুলিশ হন্যে হয়ে যেত মানুষটির সন্ধানে। কিন্তু কিছুতেই ধরা যেত না রাঘব বোয়ালকে… 

তবে কেবল ব্রুকলিন ব্রিজ বেচেই ক্ষান্ত হননি জর্জ। মাঝের সময় আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যও ‘বিক্রি’ করে দিয়েছিলেন তিনি। যার মধ্যে ছিল গ্রান্ট’স টোম্ব, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন, এমনকি স্ট্যাচু অফ লিবার্টিও! গ্রান্ট’স টোম্ব বিক্রির সময় নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস গ্রান্টের নাতি হিসেবে। 

১৯০৮ সাল নাগাদ প্রথমবার পুলিশের নাগালে আসেন জর্জ সি পার্কার। কিন্তু কোর্টরুম চত্বর থেকেই তিনি পালিয়ে যান ছদ্মবেশ নিয়ে। তারপর আরও একবার ধরা পড়েন; এবং এবারও পালিয়ে যান। শেষমেশ ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকাপাকিভাবে হাতকড়া ওঠে তাঁর হাতে। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন জর্জ সি পার্কার। আমেরিকার সিং সিং কারাগারে জীবনের শেষ দিন অবধি কাটান তিনি। অবশ্য জেলের ভেতরেও রীতিমতো বিখ্যাত ছিলেন জর্জ। নিজের সমস্ত কীর্তিকলাপ গল্পের আকারে সেখানে শোনান তিনি। কিন্তু সেই সময় দীর্ঘ হয়নি। কারাবরণ করার আট বছরের মধ্যেই মারা যান জর্জ সি পার্কার। সেইসঙ্গে আমেরিকার অন্যতম বড়ো ‘কন-ম্যান’ হিসেবে জায়গা পান ইতিহাসে। শুধু কি ইতিহাস? ব্রুকলিন ব্রিজ যতদিন থাকবে, ততদিন থেকে যাবেন জর্জ সি পার্কারও। 

আরও পড়ুন
বিক্রির পথে ২৬টি রাষ্ট্রীয় সংস্থা; পরিষেবা ‘ভালো’ রাখতে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের?

Powered by Froala Editor

More From Author See More