না, এই কাহিনি কোনো সিরিয়াল কিলারের নয়। বরং একজন সরকারি কর্মচারীর গল্প। কিন্তু মানুষ হত্যা তাঁর কাছে নেশায় পরিণত হয়েছিল। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন তিনিই। গিনেস বুকের রেকর্ড অনুযায়ী, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন রাশিয়ার সরকারি কর্মচারী ভাসিলি ব্লোখিন। আর তার সংখ্যাটা? সারা জীবনে আনুমানিক ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন ভাসিলি। আর এর মধ্যে মাত্র ২৮ দিনে তিনি হত্যা করেছিলেন প্রায় ৭ হাজার মানুষকে। রাশিয়ার এই হত্যাকারীর সঙ্গে জড়িয়ে দুই বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসও।
ভাসিলির বেড়ে ওঠা সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য জানা যায় না। যা জানা যায় তা হল, ১৮৯৫ সালে মস্কোর কাছে কোনো গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম ভাসিলির। বয়স ২০ বছর হলে তিনি মস্কো শহরে একটি ইটভাটায় কাজ করতে শুরু করেন। আর এর মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে যায় রাশিয়াও। ভাসিলি তখন যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। কিছুদিনের মধ্যেই আবার রাশিয়ায় শুরু হল বিপ্লব প্রচেষ্টা। তখন জারের বাহিনীর হয়ে নানা গুপ্ত হত্যাকাণ্ডের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন ভাসিলি ব্লোখিন। তবে এভাবেও বিপ্লব দমন সম্ভব হল না। ১৯১৭ সালে মার্চ মাসে জারতন্ত্রের পতন ঘটল এবং নভেম্বর মাসে তৈরি হল সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রথমে শারীরিক অসুস্থতার জন্য গ্রামে ফিরে এলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার মস্কো ফিরলেন ভাসিলি। আর কিছুদিন আগে যে বিপ্লবীদের তিনি গোপনে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন, এবার তাঁদের সরকারের হয়েই কাজ শুরু করলেন।
ইতিমধ্যে রাশিয়ায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গোপন পুলিশবাহিনী। আর সেই বাহিনীতেই যোগ দিলেন ভাসিলি ব্লোখিন। প্রথম কয়েক বছর অবশ্য তেমন কোনো কাজ ছিল না। তবে ১৯২৭ সালের মধ্যেই ভাসিলি হয়ে উঠলেন গোপন বাহিনীর চিফ এগজিকিউশনার। আর ১৯৩৫ সাল নাগাদ জোসেফ স্তালিনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল। ক্রমশ স্তালিনের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন ভাসিলি। আর এর মধ্যেই ভাসিলির মন্ত্রণায় শুরু হল একের পর এক হত্যাকাণ্ড। যেখানেই প্রতিবিপ্লবের কোনো সন্দেহ দেখা দেয়, সেখানেই সহজ সমাধান হিসাবে বেছে নেওয়া হয় হত্যাকেই। আর ভাসিলি এর মধ্যেই এক নৃশংস হত্যা-পদ্ধতির অবতারণা করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রথমে হাত পা মুড়ে, হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসানো হত। তারপর মাথার পিছন দিক দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত।
এর মধ্যেই অবশ্য সোভিয়েতের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বারবার সচেতন করেছেন স্তালিনকে। ভাসিলির পরিকল্পনা যে বিপ্লবের মূল আদর্শের সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেটাই বলতে চেয়েছিলেন সকলে। কিন্তু স্তালিন কোনো কথাই কানে নেননি। ভাসিলির উপর তখন তাঁর অগাধ আস্থা। আর এর মধ্যেই এসে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পোল্যান্ডকে ঘিরে তখন রাশিয়া এবং জার্মানির মধ্যে সামরিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। দুই বাহিনীর কাছে পোলিশরা ছিলেন ঘোর সন্দেহজনক। আর এবারেও ভাসিলির পরামর্শে হত্যার বিধান দিলেন স্তালিন। পোল্যান্ডের যেসমস্ত অধিবাসী রাশিয়ার বাহিনীতে যোগ দেবেন, তাঁরা বেঁচে যাবেন। কিন্তু তা না হলেই মৃত্যু অনিবার্য। আর এই সময়েই ঘটে যায় কুখ্যাত কাটিন হত্যাকাণ্ড। কাটিন শহরে একটি গোপন আস্তানায় বন্দিদের হত্যা করা হয় একে একে। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ জন মানুষকে মাথার পিছন দিক দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত। আর এই সময়েই ২৮ দিনের মধ্যে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করেন ভাসিলি।
পরে জার্মানির প্রচেষ্টায় কাটিন হত্যাকাণ্ডের কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও রাশিয়া দাবি করেছিল, পুরোটাই জার্মানির ষড়যন্ত্র। সোভিয়েত সরকার এমন কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তবে ২০১৩ সালে বেশ কিছু পুরনো নথি প্রকাশ পায়, যাতে প্রমাণিত হয় কাটিন হত্যাকাণ্ড আসলে রাশিয়ারই পরিকল্পনা মতো ঘটেছিল। আর সেইসঙ্গে আবারও উঠে আসে ভাসিলি ব্লোখিনের নাম। সোভিয়ের সরকারের গোপনীয়তার কারণেই জানা সম্ভব নয় তিনি সারা জীবনে কত মানুষকে হত্যা করেছেন। তবে সংখ্যাটা কিছুতেই ২০ হাজারের কম নয়। ১৯৫৩ সালে স্তালিনের ক্ষমতা শেষ হলে অবশ্য ভাসিলির ক্ষমতাও শেষ হয়। তাঁকে রুশ বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। শেষ জীবনে হতাশা আর মদই হয়ে ওঠে তাঁর আশ্রয়। ১৯৫৫ সালে মৃত্যু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের নায়কের।
তথ্যসূত্রঃ How Stalin’s Favorite Executioner Vasily Blokhin Personally Killed 7,000 Poles During The Katyn Massacre, Morgan Dunn, All That Interesting
আরও পড়ুন
টুইটার ব্যবহার করে একের পর এক হত্যা, জাপানের কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারকে মৃত্যুদণ্ড
Powered by Froala Editor