নিউ ইয়র্ক থেকে জাহাজ ছেড়েছে ভারতের উদ্দেশ্যে। আদিগন্ত সমুদ্রের বুক ধরে এগোচ্ছে সেই দৈত্য। দৈত্যের পেটের ভেতর বসে আছেন এক ফাদার। নিজের জায়গা কানাডা ছেড়ে চলেছেন নতুন এক দেশের কাছে। সেখানকার মানুষ কীরকম, সংস্কৃতি কীরকম তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। হঠাৎই শুনলেন, ভারতের কলকাতায় একটি ট্রিলজি দেখানো হচ্ছে। পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়। জাহাজে যেতে যেতে সেই ট্রিলজির হাত ধরেই যেন প্রথমবার পরিচয় মানুষগুলোর সঙ্গে। ওই তো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আমার সর্বজয়া, হরিহরের সংসার! ট্রামরাস্তা ধরে ছুট দিয়েছে অপু। কোথায় থামবে সে? অবাক বিস্ময়ে কল্লোলিনীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ। শিরায় শিরায় ঢুকে গেল সেই ‘দস্যি’ অপু; বাকি জীবনটা সেই চলচ্চিত্রের সঙ্গেই কাটিয়ে দিলেন তিনি।
জীবন শুরু খ্রিস্টান ধর্মযাজক হিসেবে। কানাডায় সোসাইটি অফ জেসাসে যোগদান করেন। সেই সূত্রেই ভারতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। এ তো গেল প্রাথমিক কথা। ফাদার রোবের্জ সেই মানুষদের মধ্যে একজন, যারা ধর্ম-সংস্কৃতির বেড়াজাল ভেঙে শিল্পের প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেই প্রেমই অদৃষ্টে লিখে রেখেছিল ১৯৬১ সালের কথা; যেদিন কলকাতায় প্রথম পা দিলেন তিনি। সেই ছোটবেলায় মামার মুখে শোনা ভারতের কথা। ভারতের সংস্কৃতি, মানুষ, ঐতিহ্য— এসব শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তেন, টেরই পেতেন না! দেশ মানে তো একটা মানচিত্র নয়; সেখানকার মানুষরাও জড়িয়ে আছেন তার সঙ্গে। মানুষ! ধর্মের এই সারসত্যকেই গ্রহণ করেছিলেন ফাদার রোবের্জ। ক্রিশ্চান মিশনারি হয়ে শহরে এসেছিলেন; মিশে যান বাকি ধর্মের সঙ্গেও। তাই বোধহয় উল্টোদিকের মানুষটার মতামতেরও গুরুত্ব দিতেন।
আর ছিল সিনেমা। এমন একটা শক্তিশালী মাধ্যমেই ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাঁর নিজের ঘরটিতে যিশুর ছবির পাশেই রাখা আরও দুটি ছবি। সত্যজিৎ রায় এবং বিমল করের। সেই অপু ট্রিলজি, সেই জাহাজ— গভীর রাতে এক নিঃশ্বাসে দেখে ফেলা তিনটে সিনেমা। ‘পথের পাঁচালী’ দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা গ্রাস করা— সেদিনেই ঠিক করে নিয়েছিলেন এই মানুষটাকে চিনতে হবে। তাঁর ছবি দেখতে হবে। এবং শিখতে হবে বাংলা ভাষা। সত্যজিতের সিনেমা বুঝবেন বলেই বাংলা শেখা শুরু। আর সিনেমা বুঝবেন বলে থিয়েটার আর সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা শুরু। তখনকার দিনে সিনেমা ছিল একটা বিনোদনের মাধ্যম। এটা যে পড়ার বিষয়ও হতে পারে, শেখার বিষয়ও হতে পারে সে ব্যাপারে মাথা ঘামাননি কেউ। আজকের ফিল্ম স্টাডিজের যুগে কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না কথাগুলো? ফাদার রোবের্জ সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করলেন।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে থাকাকালীনই ঠিক করেছিলেন, চলচ্চিত্র শিক্ষা নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। এই ‘কিছু একটা’ করার তাগিদ থেকেই ১৯৭০ সালে জন্ম ‘চিত্রবাণী’র। কলকাতা তো বটেই, গোটা পূর্ব ভারতে ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে সবথেকে পুরনো প্রতিষ্ঠান এটি। সিনেমাকে কীভাবে বুঝতে হয়, কীভাবে সেটাকে পড়াশোনা করতে হয় এই রাস্তাটাই দেখিয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীকালে যে রাস্তায় হেঁটেছে অনেকে। এমনকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে আলাদা একটি বিভাগ শুরু হবার সময়ও নানা ভাবে সাহায্য করেছেন তিনি।
একটা অন্য দেশ। তার সংস্কৃতি, ভাষা, পরিবেশ সব ভিন্ন। সেখানে এসে তাঁদের সঙ্গে একেবারে মিশে যাওয়া, এবং তাঁদেরই একজন হয়ে ওঠা— ফাদার রোবের্জ এইভাবেই একটা জায়গা তৈরি করেছিলেন। একের পর এক বই লিখে চলচ্চিত্র বিষয়টাকে বোঝানোরও চেষ্টা করেছেন। উইলিয়াম কেরি, ফাদার দাঁতিয়েন, ফাদার আতোয়াঁ– এই ধারারই অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন ফাদার রোবের্জ। জেসুইট ফাদার হিসেবে কলকাতায় এলেন, তারপর এটাই তাঁর নিজের শহর হয়ে উঠল। আর ফিরেও যাননি মাতৃভূমিতে। আর বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার কথা উঠলেই চলে যেতেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। হ্যাঁ, সেই সত্যজিৎ। তবে কেউ যদি অন্য মানসিকতার হত, কেউ যদি তাঁর মতের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ভিন্ন কথা বলত, তাঁকেও সুযোগ করে দিতেন। এই উদারতাই বোধহয় পেয়েছিলেন বিভিন্ন ধর্ম অধ্যায়ন করে। আর মানুষের থেকে, শিল্পের থেকে বড়ো ধর্ম কি কিছু আছে!
আর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মনে মনে তাঁর সঙ্গে একটা সংলাপও তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি, ‘ডায়লগ উইথ টেগোর’। সবকিছুতেই পশ্চিমমুখী হওয়াটা আমাদের অনেকেরই মজ্জাগত। কিন্তু আমাদের কাছেও যে সংস্কৃতির বিরাট ভাণ্ডার রয়েছে, তাকেও যে নানাভাবে জীবনের ভেতর প্রবিষ্ট করানো যায়, এই কথাটা খুব কম সময়ই ভাবি আমরা। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এই কথাটাই বারবার বুঝতে চেয়েছেন ফাদার রোবের্জ; বোঝাতেও চেয়েছেন। ৮৫ বছর বয়সে সেন্ট জেভিয়ার্সের সেই ঘরটা থেকে চিরকালের মতো বিদায় নিলেন তিনি। এখনও যিশুর পাশে বসে রয়েছেন সত্যজিৎ। ফাদার রোবের্জ নতুন একটি জাহাজে উঠলেন। এখনও কি খুঁজে চলেছেন সেই অপু’কে? জানা নেই। ফাদার জানিয়ে গেলেন না। কলকাতার মন আজ বিষণ্ণ। ধ্যান আশ্রমের সমাধিটার পাশে দাঁড়িয়ে চিত্রবাণীর অগুনতি পড়ুয়া। ফাদার তখন জাহাজে করে, অজানা কোনো দেশে…
আরও পড়ুন
প্রদোষ ‘মিত্র’ নয়, ফেলুদা-র পদবি ‘দত্ত’ ভেবেছিলেন সত্যজিৎ!
কৃতজ্ঞতা— সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Powered by Froala Editor