একের ওপর এক পাথর সাজিয়ে নির্মিত স্থাপত্য। এক ঝটকায় দেখলে মনে হবে শক্তিশালী কোনো আঠা দিয়েই জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলিকে। তবে সামান্য ছুঁলেই ভুল ভেঙে যাবে। তাসের ঘরের মতোই ধসে পড়বে সেই নির্মাণ। বিস্ময় জাগছে কীভাবে নির্মিত হল এই স্থাপত্য? কীভাবে কয়েক কিলোগ্রামের এই ভারী পাথরগুলিকে সাজানো হল এমন নিখুঁত ভাবে? তা জানতে গেলে আলাপ করতে হবে মার্কিন শিল্পী মিশেল গ্র্যাবের সঙ্গে।
বিগত ১২ বছর ধরেই এই চ্যালেঞ্জিং শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত ৩৬ বছরের মিশেল। পাথরের সজ্জা তৈরি করতে তার এক মাত্র হাতিয়ার মহাকর্ষ বল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একের পর পাথরকে দাঁড় করিয়ে ফেলেন তিনি। আর একটি মাত্র বিন্দুর ওপরে ভর করেই তৈরি হয়ে যায় অদ্ভুত এই স্থাপত্য।
তবে শুরুটা হয়েছিল অদ্ভুতভাবেই। অনেকটা আকস্মিকভাবেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন মিশেল। পেশায় একজন জিওলজিস্ট ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের গ্রীষ্মের এক দুপুরে এক সহকর্মীর সঙ্গেই তিনি খোঁজ চালাচ্ছিলেন ওবসিডিয়ান নামের একটি খনিজের। তার জন্য বোল্ডার এবং ছোটো-বড়ো পাথর ভেঙেই চলছিল অনুসন্ধান। সেই সময় একটি ভাঙা পাথরকে নেহাতই সরিয়ে দেওয়া জন্য পাশে একটি বড়ো বোল্ডারের ওপর রেখেছিলেন মিশেল। আর তাতেই চমকে ওঠেন তিনি। নিছক সরিয়ে রাখা প্রস্থরখণ্ডটি একটি মাত্র সংযোগবিন্দুর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বোল্ডারের ওপর। তবে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি সেই ভারসাম্য। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই টাল হারিয়ে পড়ে যায় পাথরটি। তবে এই ‘সাইকিডেলিক’ অভিজ্ঞতা এক নতুন নেশা ধরিয়ে দেয় মিশেলের মধ্যে।
প্রকৃতি আর পদার্থবিদ্যার এই ম্যাজিকের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন মিশেল। আর তারপর থেকেই শুরু হয় তাঁর অনুশীলন। রক-বালেন্সিংয়ের অনুশীলন। শিক্ষক মিশেল নিজেই। কারণ তাঁর আগে এমন শিল্পকর্মে সেইভাবে হাত পাকাননি কেউ-ই। ২০১২ সাল নাগাদ তিনি যখন পুরোপুরি আয়ত্ত করে নেন এই শিল্পকলা, তখন ছেড়ে দেন চাকরি। শুরু হয় ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর নতুন অধ্যায়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ট্যুরের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠানেও শুরু হয় এই শিল্পের প্রদর্শন।
বর্তমানে এইসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মিশেল জোর দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি তাঁকে আরও বেশি করে ঠেলে দিয়েছে এই পথ বেছে নেওয়ার জন্য। আর সেখানে ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টের স্বীকৃতি মেলার পর থেকে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে এই মার্কিন শিল্পীর কর্মকাণ্ড। বিস্মিত নেটিজেনরাও।
আরও পড়ুন
নিজের দাড়ির চুল দিয়ে তৈরি তুলিতেই আঁকা ছবি, আন্তর্জাতিক সম্মান হিমাচলের শিল্পীর
মিশেল জানান, যে কোনো ধরণ বা আকারের পাথর ব্যবহারেই তিনি তৈরি করতে পারেন এই স্থাপত্য। পাথর বাছাইয়ে তেমন কোনো বিশেষ শর্ত নেই তাঁর। তবে ভারী ও শক্ত পাথরে ভারসাম্য বেশি থাকায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রানাইট ও বোল্ডার ব্যবহার করেন তিনি। তারপর খেলা শুরু হয় ধৈর্য এবং ব্যালেন্সিংয়ের।
তবে মিশেলের বিশ্বাস পৃথিবীতে প্রথম শিল্পী হিসাবে তিনি এই স্থাপত্য তৈরি করেননি। তাঁরও বহু বহু কোটি বছর আগে থেকেই পৃথিবীতে দৃশ্যমান এমন শিল্প। শিল্পী স্বয়ং প্রকৃতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রাকৃতিক ব্যালেন্সিং রক তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বলেই জানান মিশেল। আর প্রকৃতিকে ভালোবেসেই এই চ্যালেঞ্জিং কাজ করে চলেছেন তিনি। তবে প্রাকৃতিক ব্যালেন্সিং রকের ক্ষেত্রে পাথরগুলির ভর কয়েক হাজার টন হওয়ায় মানুষের স্পর্শে বা ভারে বিন্দুমাত্র নড়ানো যায় না তাদের। অন্যদিকে মিশেলের স্থাপত্য ভঙ্গুর। পার্থক্য শুধু এইটুকুই।
আরও পড়ুন
তাঁকে ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন বলিউডের খলনায়ক! প্রয়াত কিংবদন্তি পোস্টার শিল্পী দিবাকর কারকারে
তবে নিজের তৈরি একটি স্থাপত্যকেও মিশেল সংরক্ষণ করেননি। ব্যালেন্সিং রক তৈরি করার কয়েক ঘণ্টা পর, বা প্রদর্শনীর শেষে নিজেই তা ভেঙে ফেলেন মিশেল। তাঁর বিশ্বাস প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত একজন শিল্পীর। আর সেজন্যই নিজের স্থাপত্যকে শেষ পর্যন্ত ‘ধ্বংস’ করে ফেলেন তিনি নিজেই। শুধু এই শিল্পের অভিনবত্বই নজর কাড়ে না, তাঁর মানসিকতাও বিস্ময় জাগায় রীতিমতো। একজন প্রকৃত প্রকৃতিপ্রেমী না হলে এমনটা হওয়ার কথাও নয়।
নিজের ব্যক্তিগত অভিযানের সময় কখনও পাহাড়ি ঝোরার মধ্যে, কখনও বা পাহাড়ের প্রান্তদেশে চূড়ান্ত বায়ুপ্রভাবের মধ্যেই এমন নির্মাণ তৈরি করেছেন মিশেল। শুনলে অবাক লাগবে, প্রায় প্রতিদিনই এমন কোনো না কোনো স্থাপত্য তৈরি করেন তিনি। যা সামনাসামনি না দেখলে অবিশ্বাস্যই। মার্কিন প্রদেশের সেইসব জায়গায় ঘুরতে গেলেও সেই স্থাপত্য দেখতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই আর। কেননা তাদের অস্তিত্ব নিজেই মুছে দিয়েছেন শিল্পী। শুধু এই অভিনব দৃশ্য চাক্ষুষ করার একমাত্র উপায় তাঁর প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া কিংবা তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট। যা শিহরণ জাগানোর জন্য যথেষ্ট...
আরও পড়ুন
কোভিডে মৃতদের শ্রদ্ধা জানাতে ৬৫৬১টি ‘লৌহপুষ্প’ স্থাপন সুইডেনের শিল্পীর
Powered by Froala Editor